আমি যখন ২০০৬ জুনে সাভার ইপিজেড এ কাজে জয়েন করি তখন থেকে, কর্মস্থলে যাবার কালে পথ মধ্যে, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটের ঠিক উল্টা দিকে, সাভার ডেইরী ফার্মের ডান পাশে দেখতে পাই লাল ইটের বাঁধান একটি কবর।কবরে উপরে দুটি ফুল গাছ, একটি বকুল অন্যটি কামিনী যেন কবরটিকে ছায়া দিয়ে গভীর মমতায় আগলে রেখেছে। লাল ইটের দেওয়ালে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর টিটু। স্বভাবত কৌতুহল জাগে কে এই টিটু ? আর তার কবর বা বেদী এখানে কেন?
গাড়ির সহযাত্রীদের কয়েক বার জিজ্ঞেসও করে দেখেছি কেউই জবাব দিতে পারেন নাই। অবশেষে গত ২১শের বই মেলায় কিনা সদেরা সুজন সম্পাদনায় আমার দেখা ১৯৭১ বইয়ে ইমরুল ইউসুফের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা টিটোর গল্প পড়ে এই মুক্তিযোদ্ধার কাহিনী জানতে পারি। শহীদ টিটুর প্রতি আমার শ্রদ্ধায় বুক ভরে উঠে। হয়তো অনেকে জানেন তবুও যারা জানেন না তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে এই কাহিনী বর্ণনা করছি।
মানিকগঞ্জের শ্যামলা রঙ এর কিশোর ছেলে টিটু, চোখে ছিল দুনিয়ার মায়া ভরা দৃষ্টি, ক্লাস সেভেনে পড়তেন। ঐ বয়সের কিশোরা যা যা করত টিটুও ২৫শে মার্চের আগে তাই করতেন- ফাঁদ দিয়ে ঘুঘু ধরে, নদীতে সাঁতার কেটে, নৌকাও বেয়ে হাসি আনন্দে সময় কাটাতেন। কিন্তু ২৫শে মার্চ এই কিশোরটার সব কৈশোরের অভ্যাস দানবদের নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে নিমিষে বদলে দিল। কারণ ঐ দানবরা ওর ভাইকে রাইফেলে লাগানো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে, তার সারা গ্রাম জ্বালিয়ে পোঁড়ে ভস্মিভুত করে। ওর চোখের সামনে খান সেনারা কয়েক’শ নিরীহ মানুষকে মেরে আগুন দিয়ে পোড়ে ফেলে।
তাই সে প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করে এবং ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা পথ খুঁজতে থাকে। অবশেষে দুই নম্বর সেকটর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা হয়।ওর অভিপ্রায় জানায়। খালেদ মোশাররফ, এক যুদ্ধ পূর্ণ গভীর রাতে এই কিশোরকে, সাভারের মুক্তিযুদ্ধা টিম লিডার- নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কাছে দিয়ে যান।
অল্প সময়ের মধ্যে টিটুর সাথে নাসির উদ্দিন ইউসুফের খুব ভাব হয়ে যায়। টিটুর কেবল এক আবদার সে যুদ্ধ করবে, তাকে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে হবে। বাচ্চু ভাবেন মাত্র ১৫ বছরের কিশোরকে যুদ্ধে জড়ান ঠিক হবে না। জিজ্ঞেস করেন- তুমিতো এতো ছোট কেমন করে যুদ্ধ করবে? টিটু দৃপ্ত ভাবে চিত্কার করে বলে- আমি অগো বেবাকরে মাইরা ফালামু,ওরা আমার ভাইরে মারছে। আমি অগোরে আগুনে পুইড়া ছাই বানাবো।ওরা আমাগো গ্রাম গুলোকে পুইড়া ছাই বানাইছে। সব কয়টারে গুলি করে মাইরা প্রতিশোধ নেব।
বাচ্চু এতটুকু কিশোরের প্রতিশোধ স্পৃহা দেখে জিজ্ঞেস করেন- টিটু স্বাধীনতা বলতে কি তুমি জানো? টিটু বলে- হ’ জানি! সবাই কয় দেশ স্বাধীন হইলে সবাই নাকি সুখে থাকবো। ভাত কাপড়ের অভাব হইবোনা। দ্যাশ থিক্যা অশান্তি দুর হইবো। আমি স্বাধীনতা দেখমু। আমি যুদ্ধ করুম।
যদিও টিটুকে কিছু অস্ত্র ব্যবহার শেখানো হলো কিন্তু বয়সে খুব ছোট থাকায় তাকে সরাসরি যুদ্ধে শরিক হওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো না। অথচ তার জেদ সে যুদ্ধ করবেই। তাকে বুঝানো হলো যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা শোনা সেবা যত্ন করাটাও যুদ্ধ। তাকে সে দায়িত্বটা দেওয়া হল। কয়েক দিনের মধ্যে সে সবার প্রিয় হয়ে উঠলো।
মাস খানেকের মধ্যেই ঢাকা সাভার আরিচা সড়কের দুই পাশ দখলে আসে মুক্তিযুদ্ধাদের। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সাভার থানাও ঘেরাও করে মুক্তিযুদ্ধারা।ঐ সময় একদল পাকিস্থানী সেনাদল ঢাকার পথে ফিরছিলো। এরা এসে সাভার থানার পাকিস্থানী সেনাদের সাথে যোগ দিলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।সাথে সাথে বাচ্চু ওদের প্রতিরোধে নেমে পড়লেন। ১৪ই ডিসেম্বরের ভোরে, চার’শ মুক্তিযোদ্ধাদের বাচ্চু রণকৌশল বলে দিয়ে মাত্র ৫০ জনকে জরুরী অবস্থা মোকাবেলায় রেখে, বাকী অন্যদের চার ভাগে ভাগ করে দেন। এই ৫০ জনের দলে পড়ে টিটু, সে এটা মানতে পারেনা। সে বাচ্চুকে বলে- যুদ্ধে আমারে নিয়া যান। আমিও যুদ্ধ করুম। বাচ্চু গভীর আবেগে টিটুকে আদর করে বলেন- এই যুদ্ধে আমরা অনেকে না ফিরতে পারি। তুমি থাকো। টিটু কেঁদে বলে-আপনারা সব মইরা যাইবেন আর আমি বাইছা থাকুম ক্যান? আমিও মরুম। বাচ্চু টিটুকে জড়িয়ে ধরে বলেন- টিটো তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। তুমি না স্বাধীনতা দেখতে চাও?
যুদ্ধ শুরু হলো। তুমুল লড়াই। কিন্তু হেভী মেশিন গানটিকে ধ্বংস করতে না পারলে এ যুদ্ধে পাকিস্থানীদের হারানো যাবে না।
বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে লিডার বাচ্চু সহযুদ্ধা আরিফকে নির্দেশ করলেন- সে যেন দৌঁড়ে ২ নম্বার দলের যুদ্ধা নুরুকে বলে- যেমন করে হউক ঐ হেভী মেশিন গানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। আরিফ লিডারের নির্দেশ মতো না গিয়ে, কিশোর টিটুকে নির্দেশ দিলো। যার রক্তে প্রিয়জন হারানোর প্রতিশোধ স্পৃহা ও যার চোখে এক শোষণ মুক্ত স্বাধীনতার স্বপ্ন তাকে আর কে পায়। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে নিজেকে কাভারে না রেখে লাফ দিয়ে উঠে। কোন রৃপ রাখ ঢাক ছাড়া মুক্তি পাগল কিশোর, সোজা নুরুকে লক্ষ্য করে দৌঁড়াতে লাগল আর চিত্কার করে নুরুকে বলছিলো লিডারের নির্দেশ। ঠিক তখনই শত্রু সেনার হেভী মেশিনগানের এক ঝাঁক বুলেট এসে বিদ্ধ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা কিশোর টিটুর বুকে। বুলেটের আঘাতে, আঘাতে মাটি থেকে কয়েক হাত উপরে উঠে, ধাপাস করে মাটিতে পড়ে যায় টিটুর শরীর।মেসিনগানের বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করেছে টিটুর বুক। টিটু তখন চিত্কার বাচ্চু ভাইকে ডাকে- বাচ্চু ভাই আমাকে বাঁচান।
মুক্তিযুদ্ধারা তাদের প্রিয় কিশোর টিটুর এই অবস্থা দেখে শোককে প্রতিশোধের অগ্নিতে রূপান্তরিত করে। যুদ্ধের সব নিয়ম কানুন ভুলে এক শ্বাসরুদ্ধ কর যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্থানীদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে।
যুদ্ধ শেষে প্রতিটি যুদ্ধার একটাই প্রশ্ন - টিটু বেঁচে আছে কি? হ্যাঁ সে তখনো কাতর কণ্ঠে বলে- আমারে বাঁচান! আমি স্বাধীনতা দেখুম। স্বাধীনতা দেইখ্যা মরুম।আমারে বাঁচান!!!!!
টিটুর রক্তে ভেসে গেল ক্যাম্পের মাটি। এমাটি ধন্য হলো তার আর এক সন্তানের তাজা বুকের রক্তে শিক্ত হয়ে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে টিটু আর পাশে অসহায় সব সহযোদ্ধারা। সবার চোখে অশ্রুর বন্যা। টিটু বার বার বলতে থাকে তার খুব ব্যথা করছে। খুব শীত লাগছে। সহযোদ্ধারা একে একে ২০টি কম্বল দিয়ে টিটুকে ঢেকেও শেষ রক্ষা করতে পারছে না.... টিটুর কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে...... এখন ওর শুধু ঠোঁট কাঁপছে..... এক সময় তাও বন্ধ হয়ে গেল.. টিটু এখন সকল যন্ত্রণার উর্দ্বে চলে গেছে -- মৃত্যুর সময় হয়তো বিড় বিড় করে বলে গেছে- আমিতো স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলামনা। কিন্তু আমার দেশ স্বাধীন হবে, দেশ স্বাধীন হইলে সবাই সুখে থাকবো? ভাত কাপড়ের অভাব হইবোনা?? দ্যাশ থিক্যা অশান্তি দুর হইবো???
বি.দ্র. শহীদ টিটু বেঁচে থাকলে প্রায় আমার মতো বয়সী থেকে হতেন । কারন আমিও ঐসময় সেভেনের ছাত্র ছিলাম।সেই কারণে টিটু প্রতি আমার একটু অন্য রকমে ভাব আসে, রোজ যখন ওর কবরকে পাশ কেটে যাই। অজান্তে হাতটা কপালের কাছে উঠে আসে। এই প্রজন্মের শহীদ টিটুর উত্তরসুরীদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন মনের সব কটা জানালা খোলে ভেবে দেখুন, আজ ৩৯ বছর পরেও শহীদ টিটুর স্বাধীনতার পূর্ণতা প্রাপ্তি হলোনা কেন? কারন এই দেশের ৯৯ জন মানুষই টিটুর মতো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে, দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। ব্যক্তি বিশেষ বা গোষ্ঠী বিশেষকে কোটিপতি আমলা জেনারেল প্রধান মন্ত্রী বানাতে নয়!!!!!!!
আমি স্বাধীনতার ১৬ বছরে যখন তরুণ ছিলাম তখন একটি কবিতা লিখে ছিলাম। যা আমার প্রথম ছাপানো কবিতা। আজ তা উত্সর্গ করছি এই মহান শহীদ টিটুকে। প্রিয়তমা তুমি এলেনাতুমি এলে ভস্মস্তুপ থেকেলাল সিঁদুরের টিপ পরে;তোমার মধ্য থেকে,আমার ষোড়শী প্রিয়তমাআসার কথা ছিলো,কিন্তু সে এখনও এলো না।।হতাশার কফিন থেকেতুমি উঠে এলেথেৎলানো দূর্বা ঘাসের উপরেলাল কার্পেট বিছিয়েক্ষত বিক্ষত হৃদয়েউন্মত্ত প্রস্রবণ ধারায়স্বপ্নের আলো জ্বেলে,বিক্ষুব্ধ জলোচ্ছাসে,রক্ত মাখানো পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে,যুবতী বধু অবগুণ্ঠন থেকেএক ঝিলিক আলোর চমকানো দিয়েশুধু তুমি এলে।অথচঃতোমার মধ্য থেকেযে ষোড়শী প্রিয়তমারআসার কথা ছিলোএখনও সে এলো নাপ্রিয়তমা তুমি আজো এলে না।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন