প্রিয় পাঠক, এইব্লগে বিজ্ঞ ইতিহাসবিদরা প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা প্রকাশ করে থাকেন। ঐসব লেখা গুলো সব জাতীয় পর্যায়ের কেন্দ্রিয় চরিত্রগুলো নিয়ে হয়ে থাকে। একটি কথা মনে রাখা উচিত, ১৬ ডিসেম্বর একযোগে সারা বাংলা জয় হয়নি, বরং ইতোপূর্বে বিভিন্ন তারিখে বাংলাদেশের অনেক জেলা থানা হানাদার মুক্ত হয়েছে, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এপ্রজন্ম কিংবা আগামী প্রজন্মকে সঠিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধ উপলব্ধি করাতে হলে জাতীয় পর্যায়ের সাথে সাথে আঞ্চলিক পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাদের ইতিহাসও জানাতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে আমি আমার জিলার মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আজিজ আহমদ বেগের স্মৃতিকথা নিম্নে পোষ্ট করছি। নিম্নের সব বক্তব্য মির্জা আজিজ আহমদ বেগ সাহেবের। ধন্যবাদ। মুনিম সিদ্দিকী।
আমি মৌলভীবাজারের বিজয় দেখেছি।
আজ দীর্ঘ চার দশক পর আমি মৌলভী বাজারের গণতন্ত্রের উত্তরণ ও বিজয়ের ঘটনা লিখব বলে হাতে কলম নিয়েছি। অতীতের কত বেদনাদায়ক ও আনন্দমুখর স্মৃতি আজ চোখের সামনে ভেসে ওঠছে। আমার রাজনৈতিক সহকর্মীদের অধিকাংশই আজ বেঁচে নেই। অনাগত ভবিষ্যতের ইতিহাসে তারা যেন স্থান পান সেজন্যে লিখতে বসেছি। যারা বেচে আছেন তরাও বারবার তাগিদ দিচ্ছেন। নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্যে আমাকে লিখতে হবে। আমি কোন লেখক নই বা ডায়রীও লিপিবদ্ধ করিনি। স্থান-কাল,পাত্র,অবস্থান বিবেচনায় এ ইতিহাস লিখতে হয়ত ভুল হতে পারে। আশাকরি পাঠক ক্ষমা করবেন। স্মৃতির জানালায় যেটুকু উঁকি দিচ্ছে তাই লিপিবদ্ধ করার চেষ্ঠা করছি। ইতিহাস আমাকে এই জন্যে লিখতে হবে যেহেতু আমিই প্রথম তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঝে ছাত্রলীগে যোগদান করি। আমি প্রথম মৌলভী বাজার ছাত্রলীগ গঠন করি, মৌলভী বাজার প্রথম আওয়ামীলীগ গঠন করি। মৌলভী বাজার আওয়ামীলীগ নেতাদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে শরণার্থী হয়ে ভারতে যাই। আমি মিত্রবাহিনীকে নিয়ে মৌলভীবাজারে সর্বপ্রথম ৮ই ডিসেম্বর প্রবেশ করি এবং পতাকা উত্তোলন করি। আমিই একমাত্র ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তার ঘনিষ্ট সহচর হিসেবে আড়াই বছর কারাবাস যাপন করি। আমিই প্রথম প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৌলভীবাজারের রাজনীতি হতে দুরে অবস্থান করছি। জানি এ ইতিহাস প্রকাশিত হলে অনেকে আমার উপর খুশি হবেন আবার অনেকে বিরাগভাজনও হতে পারেন।
২৫শে মার্চ বাঙ্গালী জাতির ভাগ্যকাশের কালো রাত্রিতে মৌলবীবাজার পাকহানাদার বাহিনী দখল করে নেয়।ফেলে। আজিজুর রহমান (তত্কালিন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) ,প্রসন্ন কুমার রায় (ব্যবসায়ী) , বলাই বাবু , বিশিষ্ট ন্যাপা কর্মী , কানুরায় সহ , অনেক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। আজিজুর রহমান কে গ্রেফতারের পর সিলেট জেলখানায় নিয়ে যায়। প্রসন্ন বাবুকে নির্যাতন করে অর্ধমৃত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখে , কানুরায় ও বলাই কে অকথ্য নির্যাতন করে মেরে ফেলে, কানু রায় এবং বলাই মৌলভীবাজারের প্রথম শহীদ। মৌলভীবাজারে আরও যে সব উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে তাদের মধ্যে তত্কালিন মৌলভীবাজার কলেজের বিশিষ্ট ছাত্রনেতা বর্তমানে প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক মানব জমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীও ছিলেন। তাকে গ্রেফতারের পর টি, টি, ইনস্টিটিউটে স্থাপিত ক্যাম্পে এনে অত্যাচারের পরে এক পর্যায়ে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেয়। ২৭ শে মার্চ একাটুনা থেকে হাজার জনতা লাঠিসোটা নিয়ে মনু নদীর উত্তর পাড়ে পাক আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাক আর্মি অবস্থান নেয় নদীর দক্ষিণ পাড়ে। মৌলভীবাজরের ইতিহাসে এটাই ছিল পাক আর্মির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ। এখানেই প্রথম সাজ্জাদুর রহমান দু’নালা বন্দুক দিয়ে পাক আর্মিদের আক্রমণ করেন। পাক আর্মিরাও জনতার উপর বেপরোয়া গুলি চালায়। এতে অনেক লোক আহত ও নিহত হন।
সাজ্জাদুর রহমানের ভাই রেনু মিয়া পাক আর্মির গুলিতে আহত হন। স্বাধীনতার পর আমি যখন মৌলভীবাজার থানার প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলাম তখন পাক আর্মির বিরুদ্ধে সাহসী সৈনিক সাজ্জাদুর রহমানের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে নাগরিক সম্বর্ধনা দিয়েছি। ২৭শে মার্চ বিকেল বেলা পাক আর্মি আমার খুঁজে আমার বাড়িতে যায় , আমি তখন লঙ্গুরপার বাজারে ছিলাম। লঙ্গুরপার বাজার আমার বাড়ি হতে এক মাইল পূর্বে অবস্থিত। সে দিন ছিল হাটবার । গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পায় আমার অবস্থানের কথা , বাজারে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে ২/৩ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে , তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল করিম মুহুরী ও তার স্ত্রী। মুহুরীর আহত মেয়ে আজ ও বেঁচে আছেন। পরের দিন চৈত্রঘাটে (আমার বাড়ির পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে) ৩০/৩৫ জন হিন্দু লোককে নির্বিচারে হত্যা করে তারা। আমার জানামতে এটাই ছিল মৌলভীবাজারের প্রথম গণহত্যা।
৪ঠা এপ্রিল শমশেসনগরে প্রতিরোধ যুদ্ধাদের এমবুশে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হওয়াতে ঐ রাত্রে ওরা মৌলভীবাজার থেকে পালিয়ে যায়। ঐদিন সকালে কমাডেন্ট মানিক চৌধুরী হবিগঞ্জ থেকে আগত মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে মৌলভীবাজার দখল করেন। তিনি মৌলবীবাজার হতে শেরপুর পর্যন্ত এলাকা ২৭শে এপ্রিল পর্যন্ত অবমুক্ত করেন। এসময় আমরা তাকে সর্বাত্নক সহযোগীতা করেছি। শেরপুর যুদ্ধে অনেক বাঙ্গালী যুবক শাহাদাত বরণ করেন , তাদের অধিকাংশ ছিলেন বর্তমান হবিগজ্ঞ জেলার অধিবাসী। এ যুদ্ধে আহত ১৫ বছরের ছাত্রলীগের কনিষ্ঠতম কর্মী আঃ মুহিত টুটু আজও বেঁচে আছেন।
২২ শে এপ্রিল আমি শহর ছেড়ে রাতে বাড়িতে এসেছিলাম, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে শুনলাম পাক আর্মি মৌলভীবাজার দখল করে নিয়েছে। আমার সাথে ছিলেন বিডিআর- এর আজিজুর রহমান সুবেদার মেজর। আমি নিঃস্ব অবস্থায় বিডিআর মেজরকে নিয়ে ভারতে কৈলাশহরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছিলাম খবরটি সত্য ছিল না। আমি সে দিন অনিশ্চিত ভবিষত্ জেনেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। এ সময় প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতে লাগল।
২৮শে এপ্রিল পাক আর্মি মৌলভীবাজার দখল করার সময় আওয়ামীলীগ ও বাম দলের অনেক বিশিষ্ট নেতার বাসা-বাড়ি আক্রমন করে এবং আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় ঐ দিন
পাক আর্মি ছিলামপুর নিবাসী উসতার মিয়া ও তার ভাইকে মাইকযোগে এলাউন্স করে মনু ব্রিজের উপর প্রদর্শনীর মাধ্যমে গুলি করে হত্যা করে। তাদের অপরাধ একটিই তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গরু জবাই করে খাইয়েছিলেন। এ ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল তত্কালিন মুসলিমলীগ নেতা ইনাম উল্লাহর।
মাত্র ১২ টাকা নিয়ে ভারতে পৌঁছালাম। পরনে একটি পাঞ্জাবী , পাজামা , আর মুজিব কোট ছাড়া কিছুই ছিল না। ভারতে পৌঁছেই খবর পেলাম পাক বাহিনী মৌলভীবাজার দখল করেনি। তাই পুনরায় ফিরে আসার উদ্যোগ গ্রহন করলাম। আমি এবং সুবাদার মেজর আজিজুর রহমান (পরবর্তীতে কৈলাশহর ন-মৌজার সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন) কৈলাশহর শহরের নিকটবর্তী চাতলাপুর বিওপি চেকপোস্টের সামনে বসে মৌলভীবাজার এসে কি করব না করব এ ব্যাপারে পরিকল্পনা করছিলাম। এসময় একজন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মেজর এসে জিজ্ঞেস করল মির্জা আজিজ বেগ কে? আমার পরিচয় দিতেই তিনি বললেন কৈলাশহরের ডিসি আপনাকে আমার সাথে যেতে বলেছেন। কৈলাশহরের ডিসি আমাকে খুঁজবেন কেন। ঠিক বুঝতে না পেরে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এদিকে বার্তাবাহক মেজর দন্ডায়মান , দুদুল্যমান অবস্থায় ডিসির সাথে দেখা করলাম। ডিসির নাম গঙ্গাদাস আই সি এস উত্তর প্রদেশের লোক। প্রথম নজরেই মনে হল তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। দিনটি ছিল ২৯ এপ্রিল।
ডিসি বললেন , জানি আপনি জয়বাংলার একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, ৩/৪ দিন হয়ে গেল ভারতে এসেছেন কিন্তু কোথায় আছেন কি করছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আপনি এখন কি করতে চান ? বললাম- দেশে ফিরে যাব বলে ভাবছি, তিনি বললেন- না দেশে যাবেন না, কারণ পাক আর্মি মৌলভীবাজার দখল করে নিয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংক বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে, আমি আপনার এখানে থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা দেব। ডিসি সাহেব আরও বললেন- কৈলাশহরে একটি জনরব উঠেছে যে, জয়বাংলার হিন্দুদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে, বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, এমনকি অমানুষিক নির্যাতন করে ব্যাপকহারে নারী পুরুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এতে কৈলাশহরে অবস্থিত ৪০ হাজার মুসলমানের উপর হিন্দুরা যে কোন সময় চড়া হতে পারে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হতে পারে। আসন্ন এ সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসন কল্পে একটি পরিকল্পনা করেছি যে, কৈলাশহরে একটি জনসমাবেশের ব্যবস্থা করব। সমাবেশে আপনি জয়বাংলার প্রকৃত অবস্থা, লোকেদের অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যা করার কারণ জয়বাংলার প্রকৃত স্বাধীকার আন্দোলনের যথার্থতা উপস্থিত লোকেদের বুঝিয়ে বলবেন। ডিসি সাহেব জোর দিয়ে বললেন- আপনার যদি কোন সমস্যা না থাকে তাহলে আজই আমি সমাবেশের ব্যবস্থা করবো। ডিসি সাহেবের গঠন মূলক সুপ্রস্তাবে রাজি হলাম। তিনি সাথে সাথে মাইক যোগে এলাউন্স করে লোকদের জানিয়ে দিলেন-
‘আজ বিকাল ৩টায় জয়বাংলার প্রকৃত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত জনসভায় বক্তব্য রাখবেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জয়বায়লার অন্যতম নেতা মির্জা আজিজ বেগ ও অন্যান্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
হাজার হাজার শরনার্থী ও ভারতীয় লোকজন যথাসময়ে সভাস্থলে উপস্থিত হলো।
উক্ত জনসভায় তিন ঘন্টা বক্তব্য দিয়ে জয়বাংলার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করলাম। জনতার কাছে আমাদের স্বাধীকার আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ,ছয়দফা , এগার দফা যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে তাদেরকে আমাদের আন্দোলনে অংশগ্রহন ও সমর্থন দেবার জন্য আহব্বান জানালাম।অত্যাচার ও গণহত্যার প্রকৃত স্বরূপ ও কারণ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করলাম । উপস্থিত হিন্দু মুসলমান বাঙ্গালী শরনার্থী ও ভারতীয়দের মধ্যে আমার বক্তব্য বিপ্লবাত্বক এনে দিল। বক্তব্য শেষ না হতেই আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রতি একাত্বতা ঘোষনা করে উপস্থিত জনতা একটি শান্তি মিছিল বের করেন। কৈলাশহর এক ভয়াবহ সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে মুক্তি পেল। এ ঘটনার পর শরনার্থী আগমন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি লাভ করল। তাদের কাছ থেকে মৌলভীবাজরের দৈনন্দিন অবস্থা জেনে নিতাম।
ডিসি কতৃক আয়োজিত সমাবেশের পর প্রায় প্রতিদিনই কৈলাশহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজে জয়বাংলার স্বাধীকারের যথার্থতা উল্লেখ করে সভা সমাবেশ করেছি। এসব সভা সমাবেশের ব্যবস্থা সেখানকার স্কুল কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীরা করত। এতে কৈলাশহরে সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা পেতাম। একটি অদ্ভূত ব্যাপার হল সেখানে তখন পর্যন্ত আমার থাকার কোন নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল না, খাওয়া- থাকার সময় হলে জয়বাংলার কোন শুভাকাঙ্খী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতেন।
কৈলাশহরের মুসলমানরা আমাদের হিংসার চোখে দেখতো বিঁধায় আমরা অনেক সময় নিরাপত্তার অভাব বোধ করতাম, এ কারণে যথাযথ কতৃপক্ষ আমার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। জয়বাংলা হতে আগত শরনার্থীদের মাঝে পাকিস্থানী অনুচর প্রবেশ করছে বুঝতে পেরে সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষ পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করলেন। তখন থেকে কৈলাশহর থানায় আমি পরিচয়দানকারীর দায়িত্ব পালন করতাম।
সপ্তাহ দিন পর মৌলভীবাজরে বিশিষ্ঠ ব্যক্তি সা’দ উল্লাহর সাথে কৈলাশহরের দক্ষিণ প্রান্তে তার শ্বশুরালয়ে দেখা হল। আমি তাকে দেখে বিব্রতবোধ করলাম, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি তো মুসলীমলীগ ঘেঁষা লোক এখানে কিভাবে এসেছেন ? তিনি বললেন, আমি এম পি আজিজুর রহমানের আত্মীয় হওয়ায় প্রাণনাশের আশংকা রয়েছে, এখানে চলে এসেছি। তিনি বাসায় বসিয়ে পানাহারের ব্যবস্থা করলেন, কথাচ্ছলে বললেন মৌলভীবাজারের দুটি দুষ্ট প্রকৃতির ছেলেকে ব্যারিস্টার আবদুল মুনতাকিম চৌধুরী এমএনএ চিহ্নিত করে জেলে পাঠিয়েছেন, আপনি ছেলে দুটোকে কোনরূপ সহযোগীতা করবেন না, সা’দ উল্লাহর নিকট থেকে ছেলেদ্বয়ের নাম জেনে নিলাম। তিনি বললেন- সৈয়দ আস্রব আলীর ছেলে সৈয়দ মহসীন আলী (বর্তমান এমপি) ও আখাইলকুড়া নিবাসী আব্দুল মোছাব্বির(বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান)।
এ দুটি নাম শোনা মাত্রই আঁতকে উঠলাম, কারণ তারা আমাদের একানিষ্ঠ কর্মী। তাদেরকে মুক্ত করার জন্য কৈলাশ শহরের কংগ্রেসের সেক্রেটারী পালিত বাবুর কাছে গেলাম, তিনি বললেন আপনি কোন চিন্তা করবেন না, তাদেও জামিনের ব্যবস্থা করব। আগামীকাল আমার সাথে কোর্টে এ ব্যাপারে দেখা করবেন এবং পেশকারকে দেবার জন্য ২০ টি টাকা নিয়ে আসবেন। পূর্বেই উল্লেখ করছি আমি ছিলাম কপর্দকহীন তাই ২০ টাকা জোগাড় করা আমার জন্য ছিল অত্যন্ত কষ্টকর বিষয়। চারদিন হয়ে গেল এ পরিমান টাকা আমার হাতে পৌঁছেনি।
পঞ্চম দিন কৈলাশহর থানার সামনে অতিরিক্ত পুলিশের উপস্থিতি দেখে জেনে নিলাম কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী এমএনএও বিগ্রেডিয়ার পান্ডে হেলিকাপ্টার থেকে এখানে এসে নামবেন। তারা হেলিকাপ্টার থেকে নেমে সরাসরি ডিসির বাংলোয় চলে গেলেন। আমিও একটি রিকসা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলাম। মানিক চৌধুরী ও ডিসি উভয়ই আমার পূর্ব পরিচিত। কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর মানিক চৌধুরীকে ছেলে দুটো সম্পর্কে অবহিত করলাম, তিনি আমার বক্তব্য শুনে ছেলে দুটোকে ছেড়ে দিতে ডিসিকে বললেন। ডিসি জেলারের নিকট একটি চিরকুট লিখে আমাকে বললেন আপনার আরও কোন কর্মী জেলে বন্দী থাকলে তাদেরও আগামীকাল আমার কোর্টে হাজির করে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন। কথামত পরদিন জেল থেকে আমি তাদেরকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি। তাদের সাথে অনেক নির্দোষ শরনার্থীকেও ছাড়িয়ে নিয়ে আসলাম। জেল থেকে বের হয়ে মহসীন আলী আমাকে বললেন- আমাকে ১০ টাকা দিন ধর্মনগরে গিয়ে আমি সিএনসি ট্রেনিং গ্রহন করবো। তাকে ১০ টাকা দিলে তিনি ট্রেনিং গ্রহন করার পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন এবং সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন।
আব্দুল মোছাব্বির আমার সাথে থাকতেন। মৌলভীবাজার অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত করতে তার বেশ ভূমিকা ছিল। তিনি পরবর্তীতে ২ বার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী এমএনএ কৈলাশহর থানার সংরক্ষিত বাসায় অবস্থান করতেন। এখান থকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সকল কাজ আনজাম দিতেন। তার বাসায় মাঝেমধ্যে ঊর্ধ্বতন অফিসার ও বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আসতে দেখেছি। তিনি আমাদেরকে অত্যন্ত সহযোগীতা করেছেন। তত্কালিন জাতীয় পরিষদের সদস্য সাবেক ন্যাশনাল টি গার্ডেনের চেয়ারম্যান বর্তমান সাংসদ এনামুল হক মোস্তফা শহীদ কে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত করার কাজে তাকে অনেক সময় দেখেছি কৈলাশহরে।
আমি মনে করি মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা মানিক চৌধুরীর নিকট ঋণী। আওয়ামীলীগ গঠনে ও মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য তাকে জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি দেবার প্রয়োজন ছিল।আজও তাকে মরণোত্তর পদকে ভূষিত করে সম্মান প্রদর্শন করা যেতে পারে। মানিক চৌধুরী কৈলাশহরে আসার সপ্তাহ দিনের মধ্যেই মৌলভীবাজার থেকে ছাত্রলীগের বিশাল কর্মী বাহিনী কৈলাশহরে আসতে লাগল।
আমরা কৈলাশহরে অবস্থানের ১০/১২ দিনের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম,এ,জি ওসমানী কৈলাশহর সার্কিট হাউজে এলেন। তিনি এখানে সামরিক বেসামরিক কতৃপক্ষের সাথে মিটিং করলেন। আমি খবর পেয়ে তার সাথে দেখা করতে এলাম। আমাকে দেখেই তিনি জড়িয়ে ধরলেন এবং কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন উপস্থিত অবস্থা সামরিক ও বেসামরিক কতৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বললেন - কৈলাশহরে পাশে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে আজিজ আহমেদ বেগের সাথে আলোচনা করবেন। তিনি আওয়ামীলীগের একানিষ্ঠ কর্মী ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। জেনারেল ওসমানী আমাকে আদেশ দিলেন জয়বাংলা থেকে শরনার্থী হয়ে আগত যুবকদেরকে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং এ পাঠিয়ে দেবেন। শরনার্থী শিবির, ইয়ুথ ক্যাম্প ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে সব লোকেদের চিহ্নিত করে ট্রেনিং এ পাঠাতাম । এ কারণে অনেক দুঃখজনক ঘটনার সাথে আমি জড়িত। ওসমানীর আদেশ আমি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি।
ইতিহাস তার নিরব সাক্ষী। দৈনতার কারণে আমাদেরকে এ সময়টি অত্যন্ত কষ্টের সাথে অতিক্রম করতে হয়েছে। মৌলভীবাজারী আমাদের নেতারা আসতেন অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে। এ কারণে কৈলাশহরে অবস্থিত নিঃস্ব অথচ একানিষ্ঠ কর্মীর সাথে তাদের ঝগড়া ঝাটি হয়েছে। এর কারণ হল অনেকের ধারণা ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক ভাঙ্গর টাকা তারা পেয়েছিলেন কিন্তু সততার সাথে কাজে ব্যয় করেননি।
আমাদের এ নিঃস্ব অবস্থায়, দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএন এ কৈলাশহরে এসে আদেশ দিলে, রাজনৈতিক কর্মীদের তালিকা তৈরী করলাম, তিনি দেয়া তালিকা নিয়ে আগরতলা জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী ইস্টার্ণ জোনের কোষাধ্য ছিলেন। তার কাছ থেকে ভাতা আনার জন্য আগরতলা গেলাম। তিনি ভাতা দিতে গড়িমসি শুরু করলেন। তাকে বললাম আপনি কেন আমাদেরকে ভাতা দেবেন না, আমাদের নেতারা কি আপনাকে মৌলভীবাজার ন্যাশনাল ব্যাংক ভেঙ্গে টাকা দেননি? তিনি বললেন- তারা মাত্র ৭ লাখ টাকা আমাদের ফান্ডে জমা দিয়েছেন, অন্যান্য জোন থেকে বহুগুন বেশী টাকা পেয়েছি।
পরের দিন চিফ অফ স্টাফ কর্ণেল এম এ রব (পরে মেজর জেনারেল) এর সহযোগীতায় জহুর আহমেদ চৌধুরীর নিকট থেকে ভাতা আদায় করেছিলাম, এ সূত্রেই পূর্বপরিচিত এম এ রবের সাথে আর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। পরবর্তীতে তিনি অনেক সাহায্য করেছেন।
জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে বাম দলের নেতারা কৈলাশহরে এসে অবস্থান নিতে থাকেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন , গজনফর আলী চৌধুরী , সৈয়দ মতিউর রহমান , আবদুল জব্বার মায়া , প্রমুখ। ন্যাপা নেতা শওকতুল ওয়াহেদ আগে থেকেই কৈলাশহর ছিলেন। তিনি সর্বোতভাবে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে গভীরভাবে স্মরণ করি। কৈলাশহরে অবস্থিত রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে কোন দ্বন্ধ দেখা দিলে তিনি তাদের মাঝে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থিত হতেন। যখন মানসিক ভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতাম তখন তিনি আমার মনোবল অটুট রাখতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতেন। সর্ব মহলে তার গ্রহনযোগ্যতা ছিল সমভাবে। সৈয়দ মতিউর রহমানের অবদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্বদা উল্লেখ থাকবে। ভাসানী ন্যাপের মধ্যে রাজা সাহেবের ভূমিকা ছিল কিংবদন্তীসম। নিঃস্বার্থভাবে তিনি দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে গিয়েছেন। তার সম্পর্কে লিখতে গেলে একাট গ্রন্থ লেখাই প্রয়োজন। তার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
বিপুল সংখ্যক শরনার্থী কৈলাশহরের মত একটি ছোট্ট শহরে অবস্থান নিয়েছিলাম। ভারতীয় অধিবাসীরা প্রীতি ও স্নেহলিঙ্গনে আমাদেরকে গ্রহন করেছিলেন। আমাদের প্রতি তাদের সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল অকল্পনীয়।
মধ্য জুলাইতে জেনারেল ওসমানী কৈলাশহরে এসে আমাকে আদেশ দিলেন- মৌলভীবাজারের ব্যাপারে আপনাকে ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কৈলাশহরে অবস্থিত মিত্রবাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান মেজর সমন সিং- এর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সমন সিং বললেন- আমাদের সঙ্গে আপনাকে সংশ্লিষ্ট রাখার জন্য ইতিপূর্বে দেওয়ান ফরিদ গাজীও পরামর্শ দিয়েছেন, সমন সিং এও বললেন, আপনি কি জানেন মৌলভীবাজারে পাক বাহিনীর বিগ্রেড হেড কোয়ার্টার স্থাপিত হয়েছে। সুতরাং এখানে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে সুক্ষাতিসুক্ষ বিচার করে কৌশলদি নির্ধারণ করতে হবে। আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে।
বললাম- আমার দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে আমি সদা প্রস্তুত। এ দিন থেকেই মৌলভীবাজার মুক্ত দিবস ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আমার ভূমিকা মিত্রবাহিনীর সাথেই সম্পৃক্ত ছিল। শমসের নগর থেকেই মৌলভীবাজারের শেষ মাথা পর্যন্ত আমার ৫০ জন গোয়েন্দা কর্মী ছিল। মৌলভীবাজার শহরেও আমার প্রচুর লোক ছিল।এই কাজে নিয়োজিত অনেক সহযোগী ও আত্মীয় স্বজনকে পাক আর্মিরা নির্মমভাবে হত্যা করছে, নির্যাতন করেছে শুধুমাত্র আমাদের নিকট খবরাখবর সরবরাহের জন্য।
এরকম একজন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারিক মিয়া (পূর্ব কালিঙ্গা)। তিনি প্রথমে আমার সাথে ভারতে যান। পরে তথ্য সরবরাহের জন্য আমি মৌলভীবাজারে পাঠাই। তিনি অত্যন্ত কষ্ট করে আমাকে রাজাকার ও পাক বাহিনীর খবরাখবর পাঠাতেন। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সৈয়দ বজলুল করিম এ বাহিনীর অন্যতম নেতা ছিলেন। এখানে শমসেরনগরের একজনের কথা না লিখলে প্রবন্ধটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তিনি শমসেরনগরের বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতা সুন্দর মিয়ার ভাই কনা মিয়া। মূলতঃ শমসেরনগর এয়ারপোর্ট এবং এর আশপাশের খবরাখবর আমরা তার মাধ্যমে পেতাম । আমার গ্রামের আব্দুস সাত্তার মেম্বরকে পাক আর্মি অকথ্য নির্যাতন করেছে। তার একমাত্র অপরাধ ছিল সে আমাকে খবরাখবর দিয়ে সাহায্য করত।
ইতিহাসের অনুল্লেখিত বিষয় প্রকাশ করা ঠিক নয়, কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম ও অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মের জানার জন্য তা লিখে যেতে বাধ্য হলাম। একথা দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে স্বীকার করতে হবে। ভারতে যারা গিয়েছিলেন, তারাই শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয় বরং দেশে অনেক লোক ছিলেন যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ।
কৈলাশহর রণাঙ্গনে যে কয়জন ব্যক্তির উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম বারডেম উপ পরিচালক ডঃ সি এম দেলোয়ার রানা। তিনি উল্কার মত প্রতিদিন একটি ক্যাম্প থেকে অন্য একটি ক্যাম্পে ঘুরে বেড়াতেন আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেয়ার জন্য। কি অপরিসীম ত্যাগ ছিল এ তরুণ ডাক্তারের। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রাধীকা মোহন গোস্বামী একটি উল্লেখযোগ্য নাম। আমি দেখেছি প্রতিদিন তিনি শরনার্থী ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে তাদের মনোবল অক্ষুন্য চেষ্টা করতেন সাহস যোগাতেন। মানিক চৌধুরীর স্ত্রী মরহুম সৈয়দা লুত্ফা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার অনির্বাণ শিখা। কৈলাশহরের এমন কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই এবং ইতিহাসে নেতা কর্মী নেই যিনি তার সেবা থেকে বাঞ্চিত হয়েছেন। তিনি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পাননি।
এমনি আরও অনেক ব্যাক্তি আছেন যাদেরকে স্বল্প পরিসরে স্মরণ করতে পারছি না। ভবিষ্যতে কখনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখলে তাদের অবদান লিপিবদ্ধ করবো। ভারতীয়দের মধ্যে অনেক ব্যক্তিত্ব আছেন যাদের নাম স্মরণ না করলে ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে না।তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক’জন হলেন এস পি মনোজ ভট্টাচার্য , কৈলাশহর থানার ওসি সন্তোষ বাবু , কৈলাশহর সড়ক পরিবহনের সেক্রেটারি নিতিশ পাল , প্রেস মালিক মোহিত লাল , কংগ্রেস সেক্রেটারি পালিত বাবু , কৈলাশহরের ডিসি গঙ্গাদাস , ক্যাপ্টেন দাসগুপ্ত , এবং নাম না জানা অনেক। তাদের সাহায্য না পেলে কৈলাশহরে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এভাবেই দেখতে দেখতে ডিসেম্বর মাস ঘনিয়ে এল। ১লা ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
মুক্তিযুদ্ধ পর্বঃ
এপ্রিল মাসের শেষের দিকে মৌলভীবাজার এলাকা পাক আর্মির দখলে চলে যাবার পর নভেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় মুক্তিবাহিনী চোরাগুপ্তা হামলা করেছে।
১লা ডিসেম্বর রাত ১০ টায় মিত্রবাহিনীর ১০ মারাঠা রেজিমেন্ট প্রথম আক্রমন করে চাতলাপুর ভিওপি চেক পোস্টে। ১০ মারাঠা রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্ণেল লক্ষণ সিং। চাতলাপুর যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ৩০ জন সদস্য শাহাদাৎ বরণ করে। অপরদিকে অনেক পাক আর্মি নিহত হয়। চাতলাপুর তুমুল যুদ্ধের পর শমসেরনগর এয়ারপোর্টে বম্বিং করা হয়। পাকিস্থানীদের শক্ত ঘাটি ছিল শমসেরনগর এয়ারপোর্টে। মিত্রবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের পর পাক আর্মি সেখানে টিকে থাকতে পারেনি। যুদ্ধ রসদ ধ্বংস ও অনেক সেনা সদস্য নিহত হবার পর শমসেরনগরের ৪ মাইল পশ্চিমে মুন্সিবাজারে এসে অবস্থান করে পাক আর্মি। শমসেরনগর এয়ারপোর্টে ও চাতলাপুর যুব্ধে শমসেরনগরের চেয়ারম্যান মুজাহিদ ক্যাপ্টেন মুজাফর আহমদ মিত্রবাহিনীকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেন।
২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী গোয়েন্দা অফিসার সমন সিং আমাকে শমসের নগর নিয়ে আসেন। শমসের নগর ডাকবাংলোয় এসে আমরা অবস্থান নেই। ডাকবাংলোয় মিত্রবাহিনীর অনেক ঊর্ধ্বতন অফিসার উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেয়ে পাক আর্মির অত্যাচারের বেদনাদায়ক চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি। এদের বাংকার থেকে অনেক নারীকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করি। মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালী নারীরা পাক বর্বরদের দ্বারা নির্যাতিত হবার এটাই প্রমাণ।
একটি আশ্চর্য ব্যাপার হলো শমসের নগর ডাকবাংলোয় অনেক বেগেজ আমরা দেখতে পাই। পালিয়ে যাবার সময় পাক আর্মি এগুলো নিয়ে যেতে সময় হয়নি। একটি ব্যাগে অনেক টাকা ও স্বর্ণালংকার পেয়েছিলাম। সম্ভবত এগুলো অত্র এলাকার লোকেদের সম্পদ। আমার কমান্ডিং অফিসার এগুলো আমাকে দিয়েছিলেন, আমি চিন্তা করলাম এ সম্পদ আমার প্রাপ্য নয়, তাই মিত্র বাহিনীর সদস্যদের মাঝে এগুলো বিতরণ করে দিলাম।
পাক মেজর সেলিমের একটি ডায়েরী পেলাম, ডায়েরীটি উর্দুতে লিপিবদ্ধ ছিল। আমি উর্দু জানতাম বলে কর্ণেল লক্ষণ সিং আমাকে পাঠোদ্ধারের জন্য বললেন। ডায়েরী শেষার্ধে একটি চিঠি পেলাম। সেলিম তার বাবার কাছে চিঠিটি লিখেছিল কিন্তু পোস্ট করতে পারেনি। চিঠির ভাষ্য ছিল এরকমঃ-
বাবা,
পূর্ব পাকিস্থানের সীমান্তের অবস্থা খুব ভয়ঙ্কার। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীরা আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে প্রায়, আপনি আমাকে অতিসত্বর পাকিস্থানে বদলি করে নেবার চেষ্টা করেন। নতুবা যেকোন সময় আমি মারা যেতে পারি। এখানকার জনগন আমাদেরকে সমর্থন করছে না। আমরাও এখানকার কোন লোককে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাদের হওয়াই সাপোর্ট (বিমান বাহিনী) নেই বললেই চলে। স্ত্রী কন্যার নিকট খবর পৌছানোর জন্য অনুরোধ চিঠিতে উল্লেখ ছিল।
সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাফেরা করলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, চারদিকে অন্ধকার, শীতের রাত, শীতের কোন বস্ত্র নেই, কাছে কোন বাড়ি ঘর ছিল না। স্টেশনের দক্ষিণে রেল লাইন দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছু দুর যাবার পর রেল লাইনের পশ্চিম পার্শে এক বাড়িতে দেখতে পেলাম ক্ষিণ আলোর ঝলকানী। বাড়িতে যেয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই একজন যুবক বেরিয়ে এল।
আমি ছিলাম সিভিল ড্রেস পরিহিত আমার সাথে একটি রিভলবার ছিল, আমার সাথে রিভলবারটি আমার কমান্ডিং অফিসার দিয়ে ছিলেন। যুবকটি দেখে ভয়ে আতকে উঠল, সে বলল আমাকে মারবেন না, আমরা মুক্তির সাপোর্টার। আমার পরিচয় দিতেই সে চিনতে পেরে সাদরে ঘরে নিয়ে বসতে দিল, রাতের খাবার খাওয়াল, পরে শুবার ব্যবস্থা করল।চোখে প্রচন্ড ঘুম কিন্তু যুদ্ধের চিন্তায় ঘুমাতে পারিনি। রেস্ট নিতে পারলাম না , ভোর হতেই বের হয়ে পড়লাম।
রাস্তায় অনেক লুটেরাকে দেখতে পেলাম, শমসেরনগর বাজার থেকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। বাধা দিয়ে ওদেরকে একাজ থেকে নিবৃত্ত করলাম। এ সময় পিছন থেকে রাতে সাহায্যকারী যুবক এসে বলল, হাজী মোঃ ওসতার আলীর পুত্রবধু ও পুত্র হান্নান মিত্রবাহিনীর শিলিং এ মারা গেছে। খবর পেয়ে আমি এদের বাড়িতে গেলাম। আমার পরিচয় পেয়ে হাজী সাহেব হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন, বললেন- বাবা আমি মুসলীম লীগের লোক। আমার পুত্র ও পুত্রবধু মারা গেছে, আমার শাস্তি হয়েছে, তোমার যদি মন চাই শাস্তি দাও নতুবা ক্ষমা কর।
মরহুম হান্নান আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। ব্যবসায়িক কারণে তিনি সে সময় সিলেটে থাকতেন। তিনি আমাকে ৬০ এর দশকে ছাত্রলীগের আন্দোলনে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। কথাটি মনে করে হাজী মোঃ ওসতার আলীকে শাস্তি দেবার কথা চিন্তা করতে পারলাম না। এখান থেকে বের হয়ে শমসেরনগর ডাকবাংলোয় চলে এলাম।
৩ ডিসেম্বর মুন্সিবাজরে পাক বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুন্সিবাজারে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহায়তায় শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করেছিল। মিত্রবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনে একজন ক্যাপ্টেন ও ২০ জন পাকিস্থানী আর্মি নিহত হয়। ওরা এখানে টিকতে না পেরে মৌলভীবাজারের দিকে পালিয়ে যায়। ৪ ডিসেম্বর সকাল ৯ টার সময় পুরো রেজিমেন্ট সহ আমরা মুন্সিবাজারের পথ ধরে এগুতে থাকি। শমসেরনগর হতে মুন্সিবাজারের দূরাত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার।
ডিসেম্বর মাস মাঠ ভরা ধান, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য, কৃষকের মনে যেমন আনন্দের জোয়ার, তেমনি আমরাও উল্লাসিত। কিন্তু প্রাকৃতিক এই শুভক্ষণে পাকিস্থানীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ পালিয়ে গেছে আবার কেউ আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। দিনের বেলা হলে ও আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিলাম। উপর থেকে অফিসিয়ালী আমাদেরকে শত্রুবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করেছে। আমাদের চলার পথে মাঝে মাঝে বলছে স্টপ। তখন আমরা থেমে যাচ্ছি এভাবে দুমাইল পথ অতিক্রম করার পর দুপুর ১ টার সময় কান্ত হয়ে এক দীঘির পাড়ে বটবৃক্ষের নিচে আমরা সবাই বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখানে চলে এলেন। তারা আমাদের সাথে আলোচনা করে সামনে অগ্রসর হবার কৌশল নির্ধারণ করলেন। বেলা ৩ টার সময় আমরা পুনরায় মুন্সিবাজারের পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকি। পিছন থেকে রেজিমেন্টের আর্টিলারী বাহিনী রাস্তা শত্রু মুক্ত করার জন্য ব্যাপক শেলিং করছে। ফলে আমরা নির্বিঘ্নে সামনে অগ্রসর হতে পেরেছিলাম।
সন্ধ্যা ৭ টায় মুন্সিবাজার পৌছি। মুন্সিবাজার একটি ইউনিয়ন ঐতিহাসিক স্থান। এখানে বাংলাদেশের লোকসাহিত্য বিশারদ কবিরত্ন আশরাফ হোসেনের বাড়ি। বাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে আমরা অবস্থান নিলাম। মুন্সিবাজারে কিছু সময় অতিবাহিত করার পর রাত ১০ টার দিকে মৌলভীবাজারের দিকে রওনা হলাম।
রাত ১২ টার দিকে আমরা বাবুবাজার নামক স্থানে উপনীত হলাম। বাবুবাজার থেকে দেওরাছড়া বাগানে ফাঁড়ি পথ দিয়ে মৌলভীবাজার পৌছার উদ্দেশ্যে পথ অতিক্রম করতে লাগলাম। অচেনা অজানা আঁকাবাকা বিপদসংকুল রাস্তা রাত যতই গভীর হচ্ছে শীতের তীব্রতা তত বেশী অনুভূত হচ্ছে, কিন্তু দেশ মাতৃকাকে শত্রমুক্ত করার মানসে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
দেওরাছড়া চা বাগানের হাসপাতালের সামনে এসে আমি এবং আমার কমান্ডিং অফিসার মাটিতে বসে পড়লাম। কান্তিতে শ্রান্তিতে এক সময় এভাবে কেটে গেল। আবার পথ চলতে শুরু করলাম মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে। দেওরাছড়া হাসপাতাল থেকে মৌলভীবাজারের রাস্তা অত্যন্ত ভয়ানক, চারিদিকে ঘন বৃক্ষরাজি, মাঠ-ঘাট কুয়াশাচ্ছন্ন, তিমির অন্ধকার, শত্রু সেনার অবস্থান আমাদের অজ্ঞাত থাকাই শত্রুর ভয়।
রাতের মধ্যে যে করেই হোক আমাদেরকে নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌছাতে হবে এ লক্ষে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে পাহাড়ের বুক চিরে আমাদেরকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। যে পথে এসেছিলাম তা এখনো মনে হলে গা শিউরে ওঠে। কারণ মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার জন্য সেদিন নিশ্চিত ভবিষ্যত্ মৃত্যমুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম। জঙ্গলাকীর্ণ রাস্তা পেরিয়ে ধান ক্ষেতর সমতল ভূমিতে উপনীত হলাম। মাঝে মাঝে আমার কমান্ডিং অফিসার থেমে যাচ্ছেন, তাকে অভয় দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের গোয়েন্দাবাগিনীর প্রধান সমন সিং শুরুতেই আমাকে ডিরেকশন দিয়েছিলেন সমতল ভূমি অতিক্রম করে একটি ছড়া পাওয়া যাবে কোন অবস্থাতেই ছড়া পার হওয়া যাবে না। কিন্তু আমি ভোর রাতে ঘুমে কাবু হয়ে রাস্তা চলছিলাম বিধায় কখন যে ছোট্ট ছড়াটি ফেলে এসেছি। কথাটি কমান্ডিং অফিসার লক্ষণ সিংকে বলার সাথে সাথে তিনি আমাকে পিছন দিকে যেতে নির্দেশ দিলেন। পিছনে হাঁটতে শুরু করলাম ঝির ঝির করে পানি প্রবাহিত ছোট্ট ছড়াটি বেশ পিছনে পেলাম।
ছড়াটি পেয়ে সাথে সাথে পাশের টিলার উপর ওঠে পড়লাম এই সে ঐতিহাসিক কালেঙ্গা টিলা। বলে রাখা প্রয়োজন যে, মৌলভীবাজার ও তার আশপাশ এলাকায় যে সব গেরিলা ভারত থেকে আসতো তারা কালেঙ্গা জঙ্গল হয়ে আসতো। পাক সেনারা যখন এ খবরটি জানতে পারল তখন থেকে তারা এখানে শক্ত ঘাটি করে বসল। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মাঝে মাঝে এ্যামবুশ করেছে, এতে পাক সৈন্য আহত নিহত হয়েছে কিন্তু তাদের স্থানটি ত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি। কালেঙ্গার দু’টিলার মাঝখানে বাংকার তৈরী করে লক্ষণ সিং তার হেড কোয়ার্টার স্থাপন করলেন। আমি এবং দুজন মেজর টিলার উপরে উঠলাম। টিলার উপর থেকে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে অনেক বাড়ি ঘর দেখতে পেলাম। ভোর তখন ৪টা এলাকাবাসী জানত না আমাদের অবস্থানের কথা, মানুষ তাদের ঘুমের অচেতনতার দরুন আমাদেরকে জানতে পারলে ও কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ ডাকে অনেকের ঘুম ভেঙে গেছে বলে আমরা ধারণা করলাম। আমি এবং মেজরদ্বয় একটি বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের ভেতর থেকে ফিস ফিস আওয়াজ শুনতে পেরে আমাদের ধারণার সত্যতা উপলব্ধি করলাম। দরজা খোলার জন্য বললাম। ঘরের লোকজন অত্যন্ত আতংকিত অবস্থায় আল্লাহর নাম পড়ছে। দরজা খুলতে খুলতে বলছে- স্যার আমরা পাকিস্থানের সমর্থক (আপ কা লুগ)। দরজা খোলার পর আমি তাদের পরিচয় জানতে পেরে বুঝতে পেরেছিলাম ওরা ঠিকই মুক্তিবাহিনীর সমর্থক। আজ হাসি পাচ্ছে মৃত্যুভয় মানুষকে কেমন বৈচিত্র্যময় করে তুলে। আমরা ঘরে প্রবেশ করে বসে পড়লাম। আমরা জানতাম পাক আর্মি অত্র এলাকায় অকথ্য অত্যাচার করছে। তাই তাদের জিজ্ঞাসা করলাম পাক আর্মি কোথায় আছে ? জবাবে ওরা বলল ওরা মাইলখানেক দূরে বড়টিলা এবং আশেপাশেই আছে। মাথারকাপন ও আমার বাড়ির নিকটে (বর্তমান চক্ষু হাসপাতাল) ওদের দেখলে। ভোর হল কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর। দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না, আশেপাশের বাড়ির লোকেদের নির্দেশ দিলাম কেউ নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যেতে পারবে না।
৫ ডিসেম্বর কালেঙ্গার পাহাড়ে (বর্ষিজোড়া পাহাড়) অবস্থান নিলাম। সকাল ৬টা হতেই আমাদের বাহিনী শেলিং করতে লাগল। পাক আর্মি ও পাল্টা শেলিং শুরু করল। দুদিক থেকে প্রচন্ড গুলাগুলির শব্দ। সারাদিন সারারাত অবিরাম উভয় দিক থেকে গুলি ছুড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি সামনে অগ্রসর হবার জন্য, কিন্তু পাক আর্মির দুর্ভেদ্য ঘাটি ভেদ করে সামনে অগ্রসর হওয়া ছিল দুরহ। বিগ্রেডিয়ার আব্দুর রহিম মতান্তরে বিগ্রেডিয়ার ইফতেখার রানার নেতৃত্বে মৌলভীবাজারে বিগ্রেড হেড কোয়ার্টার ছিল।
৬ ডিসেম্বর সারাদিন রাত উভয় বাহিনী তাদের স্ব স্ব অবস্থানে থেকে প্রচন্ড শেলিং করতে লাগল। এসময় মৌলভীবাজার প্রবেশের সবকয়টি রাস্তা পাকবাহিনীর দখল ছিল। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর আমরা মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হতে পেরেছিলাম। কালেঙ্গার প্রায় দু’কিলোমিটার পশ্চিমে বড়টিলার কাছে একটি উঁচু টিলায় ওঠার চেষ্টা করলাম। আমাদের লক্ষ্য করে এ সময় ৫০/৬০ গজ দূরে অবস্থানরত পাক আর্মি গুলি ছাড়ল। শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। এ সংঘর্ষের চিত্র এমন ভয়াবহ ছিল যা আজ মুখে বলা বা লেখা সম্ভব নয়। যুদ্ধ কখনো কল্যানকর হতে পারে না তা সেদিন আমি তীব্রভাবে অনুভব করেছিলাম।
মিত্রবাহিনীর অনেক সদস্য শাহাদাৎ বরণ করেন। অপরদিকে পাক হায়েনাদের ও বহু সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। ইতোমধ্যে আমাদের সৈন্যরা টিলার ঢালে অবস্থান নিয়ে নেয়। কমান্ডিং অফিসার আমার পাশেই অর্ধনির্মিত বাংকারে অবস্থান নিলেন। মিত্রবাহিনীর জোয়ানরা আমাকে মাটি আবৃত করে রাখল শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহনের জন্য শুধুমাত্র মুখমন্ডল মাটির উপরে ছিল। তীব্র শীত, পিপাসিত, অভুক্ত, ভয়ানক অবস্থায় আমি রাত কাটালাম। এ বিপদ সংকুল অবস্থায় পিছন থেকে আমাদের আর্টিলারী বাহিনী পাক আর্মির উপর শেলিং করতে শুরু করল। ঘন্টা খানেক সময়ের মধ্যেই পাক আর্মির গুলি বন্ধ হয়ে গেল। পাক আর্মি নাস্তানুবাদ হয়ে মাঝামাঝি রাতে অনেক ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হাটতে শুরু করল। আমরা সারা রাত আমাদের অবস্থানে অটল রইলাম।
ভোর হতে লক্ষণ সিং আমাদের নিয়ে কালেঙ্গাস্থিত অস্থায়ী হেড কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন। মিত্রবাহিনীর লোকেদের মাঝে শোকের ছায়া দেখা দিল অনেক সহকর্মীর মৃত্যুতে। কমান্ডিং অফিসার আমাকে বললেন যেভাবে হোক জোয়ানদের মনোবল অক্ষুন্ন রাখতে হবে। আমি তাদেরকে উত্সাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে হাসিখুশি রাখতে চেষ্টা করলাম।
৬ ডিসেম্বর বিপুল সংখ্যক সহকর্মীর মৃত্যু ও যুদ্ধের ভয়াবহতা লক্ষণ সিং অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিনি বাংকারে গুরু নানক পড়ে প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনা শেষে সকাল সাড়ে সাতটার সময় আমাকে ডেকে বললেন, মনে হচ্ছে পাকিস্থানীদের দুর্বল করা যাবে না, কিছুক্ষণের মধ্যেই গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান সমন সিং ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের অবস্থানে চলে এলেন। সাথে নিয়ে এলেন শমসেরনগর যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদ ক্যাপ্টেন মুজাফফর আহমদকে।
এখানে ক্যাপ্টেন মুজাফফর সম্পর্কে দু’চারটি কথা না বললে ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যাবে। ডিসেম্বর মাসে যখন কৈলাশহর ছিলাম। মৌলভীবাজারে আমার বিপুল সংখ্যক কর্মী পাক আর্মির অবস্থান,যুদ্ধ কৌশল ও তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আমার নিকট খবর পৌছাত।এ সময় গোয়ান্দা বাহিনীর প্রধান সমন সিং আমাকে শমসেরনগর এবং আসে পাশের এলাকায় পাক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জেনে রিপোর্ট দেবার জন্য নির্দেশ দেন। শমসেরনগর সম্পর্কে ইতোপূর্বে কোন ধারণা ছিল না। তাই শমসেরনগরস্থ আওয়ামীলীগ নেতৃত্ববৃন্দ যারা কৈলাশহরে ছিলেন তাদের থেকে শমসেরনগরের মুজাহিদ ক্যাপ্টেন ও চেয়ারম্যান মুজাফফর আহমেদের সহযোগীতা নেবার পরামর্শ পেয়েছিলাম। আমি সমন সিংকে মুজাফফর সাহেব সম্পর্কে অবহিত করলাম। ১লা ডিসেম্বর চাতলাপুর যুদ্ধে ও পরে শমসেরনগরের যুদ্ধের নেতৃত্ব তিনিই দিয়েছিলেন।পরবর্তীতে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করেছেন। ১লা ডিসেম্বর এয়ারপোর্টের যুদ্ধে তিনি সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন। এ অকুতোভয় যোদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানাই। মনে করি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাকে সম্মানের সাথে স্মরণ করা উচিত। সমন সিং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নিয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই সম্ভাব্য যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করেন। সকাল ৯ টার সময় মিত্রবাহিনীর চারটি ফাইটার প্লেন মৌলভীবাজার আকাশে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। দূর থেকে পাকিস্থানী আর্মির বিমান বিধবংসী গুলির আওয়াজ কি যে ভয়ানক ছিল তা প্রতক্ষ্যদর্শী ছাড়া অনুভব করা অত্যন্ত কঠিন। মৌলভীবাজারের আকাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, এ কথা চিন্তা করলে আজ আমার গা শিউরে ওঠে। মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে।মুহূর্তের মধ্যে পিটি ইনস্টিটিউট ও মৌলভীবাজার কলেজে অবস্থানরত পাক আর্মির কামানের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। আমরা ধারণা করলাম ওদের গোলা বারুদ শেষ হয়ে গিয়েছে।
আমাদেরকে বিস্মিত করে ওরা পুনরায় বাংকার থেকে মর্টার শেলিং শুরু করল। পরে বুঝতে পেরেছিলাম এটি ছিল ওদের কভারিং ফায়ার। ফাঁকে পাক আর্মি মৌলভীবাজার থেকে পালাতে শুরু করল।
মূলত ডিসেম্বরের ৭ তারিখের বম্বিংয়ের পরই পাক আর্মি বুঝতে পেরেছিল তাদের সাথে যে যুদ্ধ রসদ আছে তা দিয়ে মিত্রবাহিনীর সাথে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই তারা সম্ভাব্য পরাজয় স্বীকার করে সিলেটের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যেতে আরম্ভ করল। একটু সুযোগ হয়েছিল বিশ্রাম নেবার, হঠাৎ একজন এসে বলল- সিও সাহেব (কমান্ডিং অফিসার) আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি আসতে বলেছেন। আমি যেতেই সিও সাহেব বললেন, আমাদের জোয়ানরা একজন লোককে ধরে নিয়ে এসেছে, ভাল হলে নজরবন্দী করেন আর গুপ্তচর হলে গুলি করে হত্যা করেন। চোখ বাধা অবস্থায় তাকে আমার সামনে আনা হল। চোখ খোলার পর আমি তাকে চিনতে পারলাম সে মৌলভীবাজারের স্বনামখ্যাত ব্যবসায়ী হাজী ওছিব উল্লাহ। প্রখ্যাত মুসলীমলীগ নেতার আত্মীয়। আমি ভাবলাম এখানে তার উপস্থিতি কোন ষড়যন্ত্রের কারণ। তাই ভয়ে আতকে উঠলাম- তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এখানে কেন এসেছেন? সে কেঁদে বলল- আমার দুটি ছেলে মুক্তিবাহিনীতে গেছে, তাদের দেখতে এসেছি, শুনেছি এখানে মুক্তিবাহিনী এসেছে তাদের মা আমাকে পাঠিয়েছে তাদের দেখার জন্য। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আপনার ছেলেদের নাম কি? তিনি বললেন রকিব আর সত্তার। মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে গেল মুক্তিবাহিনীতে নয় ওরা কৈলাশহরে অবস্থান করছে। কমান্ডিং অফিসারকে ঘটনাটি খুলে বললাম, তিনি বললেন ওকে নজরবন্দী করে রাখ, এ মুহূর্তে তাকে ছাড়লে পাক আর্মির কাছে ধরা পড়বে আর ওরা ওর মাধ্যমে আমাদের সব খবর জেনে ফেলবে। জোয়ানরা কিছুক্ষণের মধ্যে আরও তিনজন লোককে ধরে নিয়ে আসল। একজন আমার গ্রামের মজিদ খান অন্য দুজন গাজিমারা গ্রামের এরফান উল্লাহ ও মঈন উদ্দিন। চিড়া, মুড়ি কলা নিয়ে ওরা আমাকে দেখতে এসেছে। ওদের নজরবন্দী করে রাখার জন্যও কমান্ডিং অফিসার নির্দেশ দিলেন।
মৌলভীবাজারে প্রবেশ করার প্রচলিত রাস্তা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা আছে কিনা- এরফান উল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলাম। এরফান উল্লাহ বললেন পাকিস্থানী আর্মি সব রাস্তায় বসে আছে শুনেছি, অন্য কোন নিরাপদ রাস্তা আছে বলে আমার জানা নেই। এ সময় ওছিব উল্লাহ হাজী বললেন, গোয়ালবাড়ীর একটি রাস্তা আছে। রাস্তাটি গোয়ালবাড়ী হয়ে জগন্নাথপুর গ্রামের মধ্যে দিয়ে মৌলভীবাজারের পশ্চিম দিকে এসে মিলেছে। এ কথা শুনে মঈন উদ্দিন বললেন, আমি এ রাস্তা চিনি, তবে রাতে ভালভাবে চোখে দেখিনা, মঈন উদ্দিন সাথে থাকলে আপনাদের নিয়ে এ রাস্তা দিয়ে মৌলভীবাজারে পৌছাতে পারব। মঈন উদ্দিন প্রস্তাবে রাজি হল। আমি এ কথা লক্ষণ সিংকে বললাম। তিনি যুদ্ধের ম্যাপ খুলে বললেন, ম্যাপেতো এ রাস্তার উল্লেখ নেই।আমি তাকে বললাম রাস্তাটি পাহাড়িয়া অপ্রচলিত রাস্তা, এ রাস্তায় রাখালদের গরু চলাচল করে ম্যাপে না থাকায় স্বাভাবিক। এক পর্যায়ে এ বিষয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হলো। তিনি বললেন- আপনার প্রস্তাবিত রাস্তা অনেক বিপদসংকুল।এ রাস্তার ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন ইনফরমেশন নেই, পদে পদে আমাদের মৃত্যুভয়। আচ্ছা কিছুক্ষণ পর সিদ্ধান্ত দেবো। দুপুর দু’টার সময় দেওরাছড়া মৌলভীবাজার রাস্তায় মিত্রবাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ী এসে থামল, অনেক ঊর্ধ্বতন অফিসার এলেন। লক্ষণ সিং একজন সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে আমাকে করমর্দন করালেন। অফিসারের কাছে আমার পরিচয় দিলেন। উক্ত অফিসার আমার নাম, ঠিকানা, অবস্থান ও বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার কিরূপ সম্পর্ক এসব বিষয় জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলেন। আমার সাথে কথা বলার পর কমান্ডিং অফিসারের সাথে একান্তে কিছু সময় বৈঠক করলেন। বৈঠক শেষে তারা চলে গেলেন। অতঃপর আমরা আমাদের অবস্থানে ফিরে এলাম। অফিসার বললেন, তিনি হলেন জেনারেল অরোরা। আমাদের যুদ্ধের অবস্থা সরোজমিনে দেখার জন্য তিনি এসেছিলেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন আজ রাতে যেভাবেই হোক আমাদেরকে মৌলভীবাজারে প্রবেশ করতে হবে। সন্ধ্যার পরপরই আমরা রওনা হলাম, মৌলভীবাজার, দেউরাছড়া এবং গোয়ালবাড়ীর ত্রিমুখ রাস্তায় আসতেই পাক আর্মি আমাদের ল্ক্ষ্য করে গুলি করতে লাগল। সম্ভবত পালিয়ে যাবার সময় ওরা কভারিং ফায়ার করছিল।
এখানে আমরা পাকিস্থানী আর্মির ফেলে যাওয়া সুরক্ষিত বাংকারে অবস্থান নিলাম। আমাদের অগ্রবর্তী ফৌজ গোয়ালবাড়ীর রাস্তা হয়ে মৌলভীবাজার রওনা হয়ে গেছে। কমান্ডিং অফিসার ও আমি পাশাপাশি দুই বাংকারে অবস্থান নিলাম, আমার বাংকারে এরফান উল্লাহ ও মজিদ খানকে রাখলাম। রাত দু’টার সময় হঠাৎ একজন সৈনিকের হোল্ড শব্দ শুনে বাংকার থেকে উঠে এসে দেখলাম পূর্বে উল্লেখিত হাজী ওছিব উল্লাকে। ভয়ে আমার গা কাটা দিয়ে উঠলো সর্বনাশ সে তো আমাদের সৈন্যদেরকে রাস্তায় ফেলে এসেছে। সৈনিককে ওছিব উল্লাহ সম্পর্কে আমাদের নিজেদের লোক পরিচয় দিয়ে আমার বাংকারে নিয়ে এলাম। এসে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের সৈন্যকে কোথায় ফেলে এসেছেন? তিনি বললেন- বাবা যে মেজর আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি মঈন উদ্দিনকে রেখে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মঈন উদ্দিন অবশিষ্ট রাস্তা চিনে ,অন্যদিকে আমি চোখে দেখিনা। আমি হামাগুড়ি দিয়ে কমান্ডিং অফিসারের বাংকারে গিয়ে প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়ে বললাম। তিনি বললেন চিন্তা করবেন না, সব কুছ ঠিক হ্যায় (সব ঠিক আছে)। আমাদের বাহিনী মৌলভীবাজারের পাশে চলে গেছে।
কমান্ডিং অফিসার লক্ষণ সিং বললেন- চিন্তা করবেন না , সব কুছ ঠিক হ্যায় । আমাদের বাহিনী মৌলভীবাজারের পাশে চলে গেছে। দশ মিনিটের মধ্যেই তিনি বললেন, চলুন।
আমরা এখন মৌলভীবাজারের দিকে চলছি, পিছনে আমাদের অসংখ্য দুধর্ষ মারাঠা সৈন্য। ভোর ৪ টায় আমরা পায়ে হেঁটে সকল বাধা অতিক্রম করে মৌলভীবাজার শহরের উপকন্ঠে আবদুর রহমানের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছাই । হঠাৎ ওয়াপদার পিডিবি রেস্ট হাউজ থেকে গ্রীণ সিগন্যাল জ্বলে উঠলো। আমি এবং কমান্ডিং অফিসার দ্রুত রেস্ট হাউজে অবস্থান নিলাম। চারদিকে নিরব নিস্তব্ধ, কুয়াশা ঢাকা ভোর, হাড় কাপানো শীত, একমাত্র কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই, নেই পাখির গুঞ্জন।
পূর্বাকাশে তারাগুলো নিভুনিভু করছে। ভীষণ উত্তেজনার মধ্যে আছি কি হচ্ছে, কি ঘটছে এ ভাবনায়। তখনকার মনের অবস্থা আজ ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না, তা শুধু প্রকট উপলব্ধির ব্যাপার। কমান্ডিং অফিসার ঘুমের রেশ কাটাবার জন্য চা তৈরী করতে সিপাহীকে নির্দেশ দিলেন। আমি ও চা পান করে ঘুমের জড়তা কাটালাম, অপেক্ষা করছি পরবর্তী সিচুয়েশনের জন্যে। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার ৩/৪ দিন পর আমি আমাদের মৌলভীবাজারের বিজয়ের প্রথম অবস্থানকে স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য ওয়াপদা রেস্ট হাউসের সামনে ছোট্ট বিজয়স্তম্ভ তৈরী করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে মৌলভীবাজারের যথাযথ কতৃপক্ষ স্মৃতিস্তম্ভটিকে সংরক্ষণ করতে পারেননি।
সূর্য ওঠার পূর্বেই লক্ষণ সিং মেজর দায়ানের নেতৃত্বে আমাকে দু’প্লাটুন সৈন্য দিয়ে আদেশ দিলেন, মৌলভীবাজার শহরে প্রবেশ করে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখল করে নেবার জন্যে। শহরের প্রবেশ মুখে বিভিন্ন স্থান সার্চ করে এসডিও বাংলোয় পৌছার ৫০ গজ পরে ব্রীজের উপরে থাকা অবস্থায় পূর্বাকাশে লাল সূর্য উঠতে দেখলাম। দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলার প্রভাতের আকাশে স্বাধীন সূর্য দেখে আনন্দের অতিশয্যে আনমনা হয়ে পড়লাম। খানিকটা পরে দায়িত্ববোধ জাগ্রত হলো। কিছুক্ষণ এখানে অবস্থান করে স্বাধীন মাতৃভূমিতে অবস্থান করতে পারায় আল্লাহর কাছে অবনত মস্তকে শুকরিয়া আদায় করি।
এসডিও’র বাংলোর দক্ষিণে আনসার গ্রাউন্ডে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের অফিস)পাক আর্মির বিপুল সংখ্যক পরিত্যক্ত অস্ত্র ও কাপড় চোপড় দেখি। সার্কিট হাউজে যখন প্রবেশ করলাম ৫/৬ জন যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখি। নগ্ন এসব মৃত নারীদেহের শেষকৃত্য সুসম্পন্ন করার নির্দেশ দেই, কিন্তু মেজর দায়ান তাকে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেবার জন্য বললেন। তাই করা হলো। সারা শহর ঘুরে একজন লোককেও পেলাম না। শহরের সকল বাড়ি-ঘর অরক্ষিত অবস্থায়। রাস্তায় পোঁতা মাইন গুলো আমাদের মাইন ডিষ্ট্রয়ার ধ্বংস করছে অথবা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পুরো শহরেই পাক বাহিনীর ব্যবহৃত ফেলে যাওয়া বিভিন্ন অস্ত্র গোলাবারুদ ও কামান দেখতে পেলাম।
বেলা ৯ টার সময় আমারা সদলবলে পশ্চিমবাজার বলিরবাগ খেয়াঘাটের সামনে পুলিশ পয়েন্টে অবস্থান নিলাম। তখন জয়বাংলার শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর উত্তর পার্শ্বে তাকিয়ে দেখলাম শত শত লোক জয়বায়লা শ্লোগান দিচ্ছে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে আমার পরিচয় দিলাম। পরিচয় পেয়ে অসংখ্য লোক নদীতে সাঁতার কেটে এপাড়ে চলে আসল। শত্রুমুক্ত মৌলভীবাজারে স্বাধীনতার আনন্দে মানুষ আত্মহারা। এ যে কি সুখ কি পরম পাওয়া।
উল্লেখিত জনতা একে একে অপরের সাথে কুলাকুলি করছে। অনেকে আবার আমাকে জড়িয়ে ধরছে। মিত্রবাহিনীর লোকজন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ৫/৭ ঘন্টা পূর্বেও যে আকাশ মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে ছিল প্রকম্পিত সে আকাশ এখন স্বাধীনতার জয়গানে উত্ফুল্যতায় মূখর। মিত্রবাহিনীর লোকেরা ও বাঙ্গালীরা সুরে সুর মিলিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে লাগল।
আমি জনতার উদ্দেশ্যে বললাম, আপনাদের কারো কাছে কি জয়বাংলার পতাকা আছে ? আমাকে দেন আমি পতাকা উড়াবো। শাহবন্দর নিবাসী লাইফ (সম্ভবতঃ কর্নেল মঈনুল হোসেনের ভাই) এগিয়ে এলো। পকেট থেকে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত একটি পতাকা বের করে আমার হাতে দিলো। আমি শত শত জনতার উপস্থিতিতে পশ্চিম বাজারের পুলিশ পয়েন্টের উপর বাংলাদেশের মানচিত্র অংকিত এ পতাকাটি উড়িয়ে দিলাম। মিত্রবাহিনীর জোয়ানরা সারিবদ্ধভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানালো।
আমি গর্বিত, আনন্দিত আমার নিজ শহরে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করার পর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিজ হাতে উত্তোলন করতে পারলাম। আমার জীবন ধন্য এ জন্য মনে করছি, আমিই মৌলভীবাজারে প্রথম ছয় দফার আন্দোলন শুরু করি। আমি প্রথমে এখানে আওয়ামীলাগ কনভেনশন করি। ছয় দফা এগার দফা সহ ঊনসত্তরের বিভিন্ন প্রোপটে শ্রম ও নেতৃত্ব দিয়েছি। মনে করি যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে ততটুকু দিতে হবে। ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃত করে নেতা হওয়া যায় কিন্তু জাতি তাকে বেশী দিন স্মরণ রাখে না। ঐতিহাসিক তথ্যগুলো যথাযথভাবে উল্লেখ করলাম, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মৌলভীবাজারের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক জানার জন্য।
বেলা ১২ টার মধ্যে মিত্রবাহিনী শেরপুর নদীর দক্ষিণ তীর পর্যন্ত দখল করল এবং অবস্থান নিলো। কমান্ডিং অফিসার বললেন আমাদের দায়িত্ব শেষ। সিলেট মুক্ত করার জন্য অন্য মিত্রবাহিনী শিলং হয়ে আসছে। শেরপুর থেকে বিকাল ৪ টার সময় মৌলভীবাজারে ফিরে এলাম। ইতোমধ্যে ১২০ মিলিমিটার গানগুলো মিত্রবাহিনীর সদস্যরা সরকারী স্কুলের মাঠে স্থাপন করল। অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার কলেজের পাশে ক্যাথলিক মিশন বিল্ডিং এ স্থাপন করা হল। যুদ্ধের পরের দিনই আমি যুদ্ধবিধ্বস্থ বিশৃঙ্খলা মৌলভীবাজারের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহন করি। সামাজিক অবকাঠামো সুবিন্যস্ত করার জন্য মিত্রবাহিনী আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, হবিগঞ্জ মৌলভীবাজার জোনের জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) মোঃ আব্দুর রব এমএনএ। মৌলভীবাজার মহাকুমার সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয় গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীকে (সাবেক এমপি)। আমাকে মৌলভীবাজার থানার সার্বিক দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে একজন প্রশাসক হিসাবে মৌলভীবাজারের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছি।
রাজাকার ও শান্তি কামিটির লোকেদের দমন করতে যেয়ে আমি অনেকের বিরাগভজন হয়ে যাই। কারণ শান্তি কমিটি ও অনেক রাজাকারের আত্মীয় স্বজন তৎকালীন প্রভাবশালী নেতৃস্থানীয় নেতা ছিলেন। একজন শান্তি কমিটির লোক ধরলে তার আত্মীয় কোন আওয়ামীলীগের লোক আমার বিরুদ্ধে চলে যায়। এ ছিল তৎকালীন বাস্তব রাজনীতি। এতে আমি বিতর্কিত ব্যক্তি। আজ অনেকদিন পরে বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে আমি আমার বক্তব্য উপস্থাপন করছি। মৌলভীবাজরের রাজনীতি থেকে অদ্যাবধি আমি এ কারণেই নির্বাসিত আছি। অনেক প্রশ্ন করতে পারেন শুনেছি আপনার প্রতাপ ছিল দুর্দান্ত তবে কেন ঘৃণিত শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের শাস্তি দিতে পারেননি ? এর জবাবে আমি বলব- তৎকালীন অবস্থা এই ছিল যে অধিকাংশ শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের আত্মীয় স্বজন ও আওয়ামীলীগ ও মুক্তিবাহিনীতে ছিল। কাউকে ধরলে নেতৃত্বস্থানীয় লোকেরা হৈ চৈ শুরু করত, আবার বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করত এদের কে ছেড়ে দেবার জন্যে। তারা এদেরকে নির্দোষ প্রমাণের জন্যে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতো। শেল্টার দিতেও কোন কোন নেতা কার্পণ্য করেননি। মৌলভীবাজারবাসীর নিকট আমার জিজ্ঞাসা এমতাবস্থায় এদেরকে গ্রেফতার করে কিভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল ?
বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হয়ে এমতাবস্থায় একমাস তের দিন পর প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দেই। মৌলভীবাজরের শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক আর্মি যাদের হত্যা করেছিল তাদের আত্মীয় স্বজন ও সন্তানদের কাছে আমি আমার অনিচ্ছাকৃত অপরাগতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এ সময় আওয়ামীলীগ ও মুক্তিবাহিনীর লোক যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদেরও নিজেদের অন্যায় ও অপরাগতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। মৌলভীবাজার জনযুদ্ধে যারা রক্ত দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। স্বাধীকার আন্দোলনে তাদের মহান ত্যাগ আল্লাহ কবুল করুন।
৮ই ডিসেম্বর আমার জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর মধ্যে গৌরবউজ্জ্বল দিন। এ দিনটি এলে আমি অনুরণিত হই, ভাবাবেগে হারিয়ে যাই কত শহীদ কত আহতদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে মিত্র বাহিনীর জোয়ানদের কথা যারা আমার দেশকে স্বাধীন করতে এসে আত্মাহুতি দিয়েছেন। আজ আমার বার বার মনে পড়ে মেজর সমন সিং, কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল লক্ষণ সিং ও অন্যান্য উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদেরকে। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে মৌলভীবাজার ৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়। একথা আজ আমি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলছি মৌলভীবাজার যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর অংশগ্রহণই ছিল অগ্রগণ্য। আজ আমি দুঃখের সঙ্গে লিখতে বাধ্য হচ্ছি বাংলার এ বিজয়ে মিত্রবাহিনীর অবদানকে অনেক স্বীকৃতি দিতে চান না,ঐতিহাসিক তথ্যগুলো বিকৃত করে ইতিহাস লেখার প্রয়াস চালানোর আদৌ যোক্তিকতা আছে কি ?
১৬ ডিসেম্বর একযোগে সারা বাংলা জয় হয়নি, বরং ইতোপূর্বে বিভিন্ন তারিখে বাংলাদেশের অনেক জেলা থানা হানাদার মুক্ত হয়েছে, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
লেখক পরিচিতিঃ মির্জা আজিজ আহমেদ বেগ। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব , অথোরাইজ্ড পারসন-রাগীব আলী সিকিউরিটিজ , ঢাকা স্টক এক্রচেঞ্জ।
যে ভাবে আমি ভেবেছি!! যে ভাবে আমি দেখেছি!!! যে ভাবে আমি বুঝেছি!!!
আমার ভাবনার লাইব্রেরীতে আপনাকে স্বাগতম! সমাজ,রাজনীতি, রাষ্ট্র ও ধর্মকে আমি যে ভাবে দেখি বা বুঝে থাকি তা এই ব্লগে গোডাউন করে রেখেছি। ভুলত্রুটি থাকা স্বাভাবিক! নিজ সময় বরবাদের জন্য নিজগুণে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ হাফেজ!
সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১১
রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১১
মুক্তিযুদ্ধে বীর নারী গীতা কর
বীর নারী রাজবাড়ির মেয়ে গীতা কর ভারতীয় উদ্বাস্তু শিবিরে সেবার কাজে নিয়োজিত ছিলেন । গীতার পিতা একাত্তরের ৫ মে নিহত হন। সর্বস্ব ত্যাগ করে গীতা ভারতে চলে যান। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতবাসীকে বাংলাদেশের পক্ষ নেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। গাইড হিসাবেও কাজ করেন তিনি। একাত্তরের ২ জুলাই গীতা কর গেরিলা ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ট্রেনিং শেষে আগরতলায় ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ হাসপাতালে মেডিক্যাল এটেনডেন্ট হিসেবে তিনি কাজ করেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দানে তিনি ছিলেন অন্ত প্রাণ। বাহাত্তরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কিছু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
দেশ মুক্তির পর একই প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে শারীরিক কারণে সেখান থেকে অবসর নিয়ে রাজবাড়িতে নিজ বাড়িতে উনার মায়ের সাথে অবস্থান করছেন। আজকের এই পোষ্ট তার চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের চালচিত্র।
গীতা করের জন্ম গ্রামীণ উচ্চ-মধ্যবিত্ত এক কৃষক পরিবারে। ১১ বোনদের মধ্যে গীতা করই প্রথম সন্তান। তাই বাল্যকাল হতে পড়াশুনার পাশাপাশি ছোট অন্য বোনদের দেখা শুনাও করতে হতো। শুধু তাই তাদের ছিল যৌথ পরিবার। সে পরিবারে ছিল তার ১৮ ভাই বোন। বাবা জিতেন্দ্র কর ছিলেন কিছুটা আধুনিক মনা এবং সামাজিক কুসংস্কার মুক্ত মানুষ। রাজবাড়ি শহরে জায়গা কিনে বাড়ি করে পরিবারের সবাইকে শহরে নিয়ে আসেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে- সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা পেতে হলে তা শহরে বাস ছাড়া সম্ভব নয়।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর থেকে সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ, অরাজকতা, খুন, রাহাজানি, লুটতরাজ! রাজবাড়ির স্বজ্জনকান্দা গ্রামেও শুরু হয়ে যায় লুটপাট আর অত্যাচার। এই পরিস্থিতিতে জিতেন্দ্র কর দিশেহারা হয়ে পড়েন। ২০ এপ্রিল মেয়েদের সম্ভ্রম হারানোর আশংকায়, বড় চার মেয়েকে নিয়ে অন্য গ্রামে আপন শ্যালকের বাড়ি চলে যান। ১৫ দিন যাবার পর ৫ই মে শ্যালকের বাড়ি আক্রমণের শিকার হয় । বাড়ির যাবতীয় মালামাল লুট হয়, এবং লুটেরাদের ছোরার আঘাতে জিতেন্দ্র কর নির্মম ভাবে নিহত হন।
এরপর দুষ্কৃতিকারীরা সে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দেয়। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য! গীতা কর ও অন্য তিন বোন -প্রাণ প্রিয় মৃত বাবার রক্তাক্ত দেহ, শিয়াল কুকুরে খাবে জেনেও প্রাণ নিয়ে,নিঃস্ব হয়ে এক কাপড়ে মামাদের সাথে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পথে অকথ্য কষ্ট স্বীকার করে, হাজার হাজার বাস্তুত্যাগীদের সাথে মিশে নয় দিন পায়ে হেটে ফরিদপুর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা পার হয়ে শিকার পুর সীমান্ত দিয়ে ভারতের মাসিমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় লন।
জিতেন্দ্র করের মৃত্যুর পর তার নিজের বাড়িও লুটপাট হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে গীতা করের মা সন্ধ্যা কর বাকী সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসেন অবশেষে ১৫/২০ দিন পর তিনিও ভারতে এসে বোনের বাড়িতে অন্যদের সাথে মিলিত হন।
ভারতে মাসীর বাড়িতেও অবস্থা সুখের ছিলনা। খাদ্য হিসাবে ছিল জংগলের কচু ও ক্যাম্পের আতপ চাল। তাও তিন বেলা জুটতো না। ক্যাম্প থেকে চাল উঠানো ছিল আরও দুর্ধর্ষ ব্যাপার! সেই কাক ডাকা ভোর থেকে হাজার হাজার মানুষ চালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। সারাদিন মানুষে মানুষে ধাক্কা ধাক্কি ও গালাগাল হজম করে কয়েকটি চাল পাওয়া যেত।
ভারতে যাবার পর থেকে গীতা করের মনের মধ্যে পিতৃহত্যা, নিজ আবাস ধ্বংস, নিজ দেশ থেকে অন্যায় ভাবে বিতাড়নের কারণে মনে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল! কেমন করে সেই সব ঘাতকদের ধ্বংস করা যায়, সে চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণের উপায় খুঁজতে থাকেন।
কোলকাতায় এসে সাজেদা চৌধুরী, নূর জাহান মোর্শদ, বদরুন্নেছা আহমদের সাথে দেখা করেন। গীতা কর ও উনার বোন ইরা কর মহিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অংশ গ্রহণে ইচ্ছুক হিসাবে নাম নথিভুক্ত করেন। এরপর প্রতিদিন ভোরে এক মুঠো পান্তা ভাত খেয়ে ২৫টি স্টেশন পাড়ি দিয়ে কোলকাতার সি,আই,টি রোডে যাওয়া আসা শুরু করেন। এই ভাবে এক মাস যাবার পর মাত্র ৭ জন বাংলাদেশী মেয়েকে নিয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়।
বর্তমান বন ও পরিবেশ মন্ত্রী সাজেদা চৌধুরীর তত্বাবধাণ কোলকাতায় নকশালদের একটি পরিত্যক্ত বাড়িকে প্রশিক্ষণের জন্য ঠিক করা হয়। সাত জন মেয়েদের মধ্যে গীতা কর ও উনার বোন ইরা কর, তুষার, কণা, মণ্ডল, আরতি সাহা, সাবিত্রী পোদ্দার ছিলেন। ১৯৭১ এর ২রা জুলাই রোজ রবিবার ক্যাম্প উদ্বোধন হয়। সেই ক্যাম্পে তাদের দেওয়া হয়- একদম কম দামের ২টি শাড়ি, একটি মগ, ছোট একটি কম্বল।
এবার শুরু হল লড়াই শেখার সংগ্রাম। কয়েক দিনের মধ্যে আরও কিছু মেয়ে এসে ট্রেনিং এ শরিক হয়। এখানে খেতে দেওয়া হত সব চেয়ে নিকৃষ্ট মানের কাঁকর মেশান ভাত। সবাইকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করা হয়। চাল বাছার দল, বাজার করার দল, রান্না করার দল। সকালে এক মগ চা, দুপুরে কাঁকর মেশানো ভাতের সাথে ডাল। রাতেও ডাল ভাত। মাঝে মাঝে সবজি জুটে যেত। ভোর পাঁচটা হতে হতো দিনের কর্মসূচি। প্রথমে শরীর চর্চা। গাছে চড়া, ক্রলিং, সাঁতার চলত সারাদিন। কোলকাতার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসে ক্লাস করাতেন। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর আলোচনা করতেন। সেন্ট জনস এম্বুলেন্স থেকে লোক এসে ফাস্ট এইড সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেন। ট্রেনিং চলা কালে বাইরের লোকজন বা আত্মীয় স্বজন হয়ে পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাজেদা চৌধুরী প্রায় এসে মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সান্ত্বনা দিয়ে যেতেন। তবে নূর জাহান মোর্শেদ, বদরুন্নেছা কম আসতেন।
দিনে দিনে কোলকাতার সেই পরিত্যক্ত নকশাল বাড়ির ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে ইচ্ছুক মহিলাদের সংখ্যা বাড়তে লাগে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের পড়ুয়া মেয়েরাও এসে যোগদেয়। তাদের মধ্যে বিভা সরকার, যূথিকা চ্যাটার্জী, লায়লা পারভিন, হাফিজা আক্তার, শিরিন বানু মিতিল, জিন্নাতুন্নেছা তালুকদার ছিলেন। অবশেষে মেয়েদের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়।
বীর নারী রাজবাড়ির মেয়ে গীতা কর ভারতীয় উদ্বাস্তু শিবিরে সেবার কাজে নিয়োজিত ছিলেন । গীতার পিতা একাত্তরের ৫ মে নিহত হন। সর্বস্ব ত্যাগ করে গীতা ভারতে চলে যান। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতবাসীকে বাংলাদেশের পক্ষ নেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। গাইড হিসাবেও কাজ করেন তিনি। একাত্তরের ২ জুলাই গীতা কর গেরিলা ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ট্রেনিং শেষে আগরতলায় ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ হাসপাতালে মেডিক্যাল এটেনডেন্ট হিসেবে তিনি কাজ করেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দানে তিনি ছিলেন অন্ত প্রাণ। বাহাত্তরের জানুয়ারির ১৬ তারিখে কিছু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
দেশ মুক্তির পর একই প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে শারীরিক কারণে সেখান থেকে অবসর নিয়ে রাজবাড়িতে নিজ বাড়িতে উনার মায়ের সাথে অবস্থান করছেন। আজকের এই পোষ্ট তার চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের চালচিত্র।
প্রশিক্ষণের শেষ পর্যায় এসে প্রশিক্ষণরত মেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয়, তাদের মধ্যে কে দলের নেতৃত্ব দিবে তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় গোলযোগ। তার উপর যুদ্ধক্ষেত্রে বিমানে করে যাবার বায়না। সাথে সকল সুযোগ সুবিধা।
সারা দেশ যেখানে শত্রু কবলিত তখন যুদ্ধ করতে আসা নেতৃস্থানীয়দের এই সব সুযোগ সুবিধা চাওয়া দেখে গীতা কররা অবাক হলেন! এই সব দাবি দাওয়া আর কে হবেন দলনেতা ,তাই নিয়ে বেশ কয়েকদিন চলে গেল।
তারপর প্রস্তাব আসে কারা বিনা দাবি দাওয়ায়, বিনা সুযোগ সুবিধায় যুদ্ধে যেতে চায়! শেষ পর্যন্ত ২০০ মেয়েদের মধ্য গীতা কর সহ মাত্র ১৫ জন মেয়ে যুদ্ধে যেতে আগ্রহ জানায়। এই ১৫ জনের দলের দল নেতা করা হলো অনিলা বিশ্বাস নামের এক মেয়েকে। অনিলা ছিলেন কলেজ ছাত্রী, গোপালগঞ্জের মেয়ে। এই দলের অন্য যারা তারা হল- গীতা কর, ইরা কর, অঞ্জলি চৌধুরী,শেফালী দাস, শোভা বৈরাগী, অনিমা ওঝা, গীতা মজুমদার,রঞ্জিতা বিশ্বাস, লক্ষ্মী মন্ডল, বিশাখা মন্ডল, ছায়া হালদার, মঞ্জু বিশ্বাস, আরতি সাহা, সাবিত্রী পোদ্দার।
বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মিজানুর রহমান ও তৎকালীন মন্ত্রীপরিষদবর্গ। বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মাত্র ১০টাকা দল নেতার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মাত্র ১০ টাকা পথ সম্বল করে আর এক অবাঙ্গালীকে পথ প্রদর্শক করে বিদায় জানান হলো মুক্তিযোদ্ধাদের। কিন্তু তাদের বলে দেওয়া হলনা কোথায় যেতে হবে কি করতে হবে!
অক্টোবর মাসের দিকে হাওড়া স্টেশন থেকে রওয়ানা হয়ে আসাম যাওয়া হয়। পথে কোন খাওয়া দাওয়া হয় নাই। এক পর্যায়ে দলের গাইড অবাঙ্গালী লোকটি মেয়েদের পথ মধ্যে ছেড়ে চলে গেলেন। উপোষ কতক্ষণ থাকা যায়! হাতে মাত্র ১০টাকা! তখন ১টাকায় ৮টি কমলা পাওয়া যেত, কাজেই শুধু কমলা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করা হল।
এভাবে চলতে চলতে দলটি সিলেটের করিমগঞ্জ সীমান্তে আসে। এখানে এসে শরণার্থী ক্যাম্প দেখতে পেয়ে দলটি ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। ক্যাম্পে ঢুকে দেখা হয় এক বাংলাদেশী ছেলের সাথে যার নাম ছিল মাখন। ৮/৯ দিনের উপোষ থেকে থেকে দলের সবার ক্ষুধার যন্ত্রণায় আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জ্ঞান হারাবার উপক্রম, তাই দলের কারো শক্তি ছিলনা যে কাউকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বলার।
বাংলাদেশী ছেলেটি মেয়েদের অবস্থা বুঝতে পেরে শিউরে উঠলেন। চট জলদি শুকনো আম পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে মেয়েদের শরীর গরম করার ব্যবস্থা করলেন। তারপর সব কিছু শুনে রেশনের চালের ফেন ভাত খাওয়ালেন। সান্ত্বনা আর আশ্বাস দিয়ে ক্যাম্পের তাবুতে মেয়েদের ঘুমাতে দিলেন।
কিন্তু বিপদ দেখা দিল আবার। ভারতীয় সেনাবাহিনী মেয়েদেরকে পাকিস্তানী গুপ্তচর হিসাবে জোর করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যেতে উদ্যোগ নেয়। সাথে অশ্লীল গালাগালি। বহু বলে কয়ে প্রমাণ করা হলো যে মেয়েরা পাকিস্তানী গুপ্তচর নয় বরং মুক্তিযোদ্ধা বাঙ্গালী মহিলা। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছু হলো না। তারা হুকুম করে তাদের ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সেবা করতে হবে। এর মধ্যে এক ফাঁকে দলনেতা অনিলা সটকে পালিয়ে যায়।
অনিলা শরণার্থী ক্যাম্প ইন চার্জের কাছে খোলে বলেন যতসব বিপদের কথা। মাখন বাবুর সহযোগিতায় কোলকাতায় সাজেদা চৌধুরীর কাছে ভীষণ কঠোর ভাষায় টেলিগ্রাম পাঠান।-
--- মেয়েদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে নিজেরা গদিতে বসে আছেন। আমাদের বিমানে পাঠানোর কথা ছিল। সে টাকা আপনারা আত্মসাৎ করে আমাদেরকে ট্রেনে পাঠিয়েছেন। নিজের সন্তান হলে নিশ্চয় নিজেরা গদিতে থেকে ঠিকানা না দিয়ে এক অবাঙ্গালীর হাতে ছাড়তেন না। যদিও জানি যুদ্ধে করতে যাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আপনাদের ভিতর কোন প্রকার মনুষ্যত্ব নাই। দেশ স্বাধীন হলে দেখে নেব-!!!!!
এতসব করার পরও একদিন মেয়েদের তাবুতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ে। তখন মাখন বাবু সহ মুক্তিযোদ্ধা মেয়েরা তাদের প্রতিহত করে।
অনিলার সেই টেলিগ্রাম পাবার পর কোলকাতা থেকে মেয়েদের যাবার জন্য নির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা জানান হয়। মাখন বাবুর কাছে কয়েক দিন মেয়েরা থেকে সুস্থ হয়ে উঠে। মাখন বাবু একটি জীপ গাড়ি করে আগরতলা পৌঁছে দেন। রাতে সাইগল নামের এক ভদ্রলোকের অফিসে রাত কাটায় মেয়েরা। সকালে সেখান থেকে আগরতলা ও কুমিল্লার সীমান্তে বিশ্রাম গঞ্জ নামক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল।
এই বিশ্রামগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর জন্য ৪৮০ বেডের একটি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল বানান হয়েছে।
এখানে মেয়েদের ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানান- ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম, ডাঃ নাজিম উদ্দিন আহমদ। সাথে আরও ছিলেন- ক্যাপ্টেন আক্তারের স্ত্রী খুকু, বেগম সুফিয়া কামালে ২ মেয়ে লুলু, টুলু, পদ্মা সরকার, নীলিমা বৈদ্য, বাসনা চক্রবর্তী সহ আরও অনেকে।
মেয়েরা সরাসরি যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে আসার পরও , এখানে থেকে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ শুনে মেয়েদের মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করা কম কথা কথা নয়। ভেবে মেয়েরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় লেগে যায়।
এই ফিল্ড হাসপাতাল প্রথমে মেলাঘরে ছিল পরে আহতের সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে এখানে স্থানান্তর করা হয়। এই হাসপাতালের ব্যয়ভার ডাঃ জাফরুল্লাহর বন্ধু লন্ডন প্রবাসী কাজী কামরুজ্জামান ও অন্যান্য ডাক্তাররা বহন করতেন। সেখান থেকে তারা নিয়মিত প্রয়োজনীয় ঔষধ ও যন্ত্রপাতি পাঠাতেন। ভারত থেকে কিছু কিছু সাহায্য পাওয়া যেত।
হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ! কারও হাত উড়ে গেছে, কারও বা পা উড়ে গেছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য! কেউ সারা রাত যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। তবুও বাংলার সাধারণ মানুষের সন্তানরা ভয়ে ভীত নয় বরং প্রবল প্রতিশোধের স্পৃহায় একটু সুস্থ হলেই যুদ্ধের জন্য রণাঙ্গনে চলে যাচ্ছে। অনেকে তাদের বাবা মা ভাই বোন আত্মীয়স্বজনকে হারিয়েছেন। কেউ তাদের খবর জানেন না। ভাবনা হাত পা উড়ে যাক তারপর তো দেশ স্বাধীন হবে।
এই ভাবে একদিন বিজয়ের ধ্বনি এলো। সবাই বিশ্রামগঞ্জের হাসপাতাল ছেড়ে ১৭ই ডিসেম্বর দেশের পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। শুধু গীতা কর সহ অন্য মেয়েরা রয়ে গেলেন। কারণ দেশে তাদের কোন নিকট জন ছিলেন না।
অবশেষে ১৫/২০ জন আহত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে কুমিল্লার সোনাইমুড়ি সীমান্ত দিয়ে মেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তদেশে প্রবেশ করেন।
আমি যখন এই পোস্ট আমারব্লগের পোস্ট করি সে সময়ে আমারব্লগের সহব্লগার অনুজপ্রতিম অনুলেখা তিনি ঘটনাক্রমে রাজবাড়িতে গিয়েছিলেন। উনি আমার পোস্টে গীতাকরের ঘটনা জানতে পেরে সরাসরি গীতাকরের সাথে দেখা করে আসেন।
বাকিটি অনুর লেখা থেকে তুলে দিচ্ছি- শুভেচ্ছা, পরিচয় পর্ব এবং উদ্দেশ্য জানাতেই কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন ঠিক এভাবে "মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম দেশের জন্য, দেশ পেয়েছি। তবে আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদানের স্বীকৃতি পাইনি। এ স্বীকৃতি দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের; সে দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে দুর্ভাগ্য আমাদের"।
অনু সাক্ষাতকার শেষে আবার গীতাকরের কাছে জানতে চান- স্বাধীনতার ৪০ বছর পর তাঁর মনে কোন দুঃখ আছে কিনা? তিনি ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে বলেন "স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে নতুন করে কিছু চাওয়ার নেই। মৃত্যুর পূর্বে চাই মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদানের সরকারী স্বীকৃতি, এই রাষ্ট্রের নিকট এটাই আমার শেষ আকুতি"।
আজ স্বাধীনতার এত বছর পর গীতা কর জাতীর কাছে জানতে চান- কত মৃত্যু, কত নির্যাতন, কত যন্ত্রণা আর কষ্ট হেলাভরে পিছনে ফেলে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর সহ শিক্ষিত মানুষেরা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু মেহনতি মানুষের ঘরে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ আজও কেন পৌছাইনি? কেন? কেন? কেন?
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গীতাকরের অবদান স্বীকার করে যে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল-
কালের কণ্ঠ
ইত্তেফাক
জনকণ্ঠ
প্রথম আলো
দেশ মুক্তির পর একই প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে শারীরিক কারণে সেখান থেকে অবসর নিয়ে রাজবাড়িতে নিজ বাড়িতে উনার মায়ের সাথে অবস্থান করছেন। আজকের এই পোষ্ট তার চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের চালচিত্র।
গীতা করের জন্ম গ্রামীণ উচ্চ-মধ্যবিত্ত এক কৃষক পরিবারে। ১১ বোনদের মধ্যে গীতা করই প্রথম সন্তান। তাই বাল্যকাল হতে পড়াশুনার পাশাপাশি ছোট অন্য বোনদের দেখা শুনাও করতে হতো। শুধু তাই তাদের ছিল যৌথ পরিবার। সে পরিবারে ছিল তার ১৮ ভাই বোন। বাবা জিতেন্দ্র কর ছিলেন কিছুটা আধুনিক মনা এবং সামাজিক কুসংস্কার মুক্ত মানুষ। রাজবাড়ি শহরে জায়গা কিনে বাড়ি করে পরিবারের সবাইকে শহরে নিয়ে আসেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে- সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা পেতে হলে তা শহরে বাস ছাড়া সম্ভব নয়।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর থেকে সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ, অরাজকতা, খুন, রাহাজানি, লুটতরাজ! রাজবাড়ির স্বজ্জনকান্দা গ্রামেও শুরু হয়ে যায় লুটপাট আর অত্যাচার। এই পরিস্থিতিতে জিতেন্দ্র কর দিশেহারা হয়ে পড়েন। ২০ এপ্রিল মেয়েদের সম্ভ্রম হারানোর আশংকায়, বড় চার মেয়েকে নিয়ে অন্য গ্রামে আপন শ্যালকের বাড়ি চলে যান। ১৫ দিন যাবার পর ৫ই মে শ্যালকের বাড়ি আক্রমণের শিকার হয় । বাড়ির যাবতীয় মালামাল লুট হয়, এবং লুটেরাদের ছোরার আঘাতে জিতেন্দ্র কর নির্মম ভাবে নিহত হন।
এরপর দুষ্কৃতিকারীরা সে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দেয়। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য! গীতা কর ও অন্য তিন বোন -প্রাণ প্রিয় মৃত বাবার রক্তাক্ত দেহ, শিয়াল কুকুরে খাবে জেনেও প্রাণ নিয়ে,নিঃস্ব হয়ে এক কাপড়ে মামাদের সাথে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পথে অকথ্য কষ্ট স্বীকার করে, হাজার হাজার বাস্তুত্যাগীদের সাথে মিশে নয় দিন পায়ে হেটে ফরিদপুর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা পার হয়ে শিকার পুর সীমান্ত দিয়ে ভারতের মাসিমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় লন।
জিতেন্দ্র করের মৃত্যুর পর তার নিজের বাড়িও লুটপাট হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে গীতা করের মা সন্ধ্যা কর বাকী সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসেন অবশেষে ১৫/২০ দিন পর তিনিও ভারতে এসে বোনের বাড়িতে অন্যদের সাথে মিলিত হন।
ভারতে মাসীর বাড়িতেও অবস্থা সুখের ছিলনা। খাদ্য হিসাবে ছিল জংগলের কচু ও ক্যাম্পের আতপ চাল। তাও তিন বেলা জুটতো না। ক্যাম্প থেকে চাল উঠানো ছিল আরও দুর্ধর্ষ ব্যাপার! সেই কাক ডাকা ভোর থেকে হাজার হাজার মানুষ চালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। সারাদিন মানুষে মানুষে ধাক্কা ধাক্কি ও গালাগাল হজম করে কয়েকটি চাল পাওয়া যেত।
ভারতে যাবার পর থেকে গীতা করের মনের মধ্যে পিতৃহত্যা, নিজ আবাস ধ্বংস, নিজ দেশ থেকে অন্যায় ভাবে বিতাড়নের কারণে মনে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল! কেমন করে সেই সব ঘাতকদের ধ্বংস করা যায়, সে চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণের উপায় খুঁজতে থাকেন।
কোলকাতায় এসে সাজেদা চৌধুরী, নূর জাহান মোর্শদ, বদরুন্নেছা আহমদের সাথে দেখা করেন। গীতা কর ও উনার বোন ইরা কর মহিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অংশ গ্রহণে ইচ্ছুক হিসাবে নাম নথিভুক্ত করেন। এরপর প্রতিদিন ভোরে এক মুঠো পান্তা ভাত খেয়ে ২৫টি স্টেশন পাড়ি দিয়ে কোলকাতার সি,আই,টি রোডে যাওয়া আসা শুরু করেন। এই ভাবে এক মাস যাবার পর মাত্র ৭ জন বাংলাদেশী মেয়েকে নিয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়।
বর্তমান বন ও পরিবেশ মন্ত্রী সাজেদা চৌধুরীর তত্বাবধাণ কোলকাতায় নকশালদের একটি পরিত্যক্ত বাড়িকে প্রশিক্ষণের জন্য ঠিক করা হয়। সাত জন মেয়েদের মধ্যে গীতা কর ও উনার বোন ইরা কর, তুষার, কণা, মণ্ডল, আরতি সাহা, সাবিত্রী পোদ্দার ছিলেন। ১৯৭১ এর ২রা জুলাই রোজ রবিবার ক্যাম্প উদ্বোধন হয়। সেই ক্যাম্পে তাদের দেওয়া হয়- একদম কম দামের ২টি শাড়ি, একটি মগ, ছোট একটি কম্বল।
এবার শুরু হল লড়াই শেখার সংগ্রাম। কয়েক দিনের মধ্যে আরও কিছু মেয়ে এসে ট্রেনিং এ শরিক হয়। এখানে খেতে দেওয়া হত সব চেয়ে নিকৃষ্ট মানের কাঁকর মেশান ভাত। সবাইকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করা হয়। চাল বাছার দল, বাজার করার দল, রান্না করার দল। সকালে এক মগ চা, দুপুরে কাঁকর মেশানো ভাতের সাথে ডাল। রাতেও ডাল ভাত। মাঝে মাঝে সবজি জুটে যেত। ভোর পাঁচটা হতে হতো দিনের কর্মসূচি। প্রথমে শরীর চর্চা। গাছে চড়া, ক্রলিং, সাঁতার চলত সারাদিন। কোলকাতার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসে ক্লাস করাতেন। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর আলোচনা করতেন। সেন্ট জনস এম্বুলেন্স থেকে লোক এসে ফাস্ট এইড সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেন। ট্রেনিং চলা কালে বাইরের লোকজন বা আত্মীয় স্বজন হয়ে পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাজেদা চৌধুরী প্রায় এসে মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সান্ত্বনা দিয়ে যেতেন। তবে নূর জাহান মোর্শেদ, বদরুন্নেছা কম আসতেন।
দিনে দিনে কোলকাতার সেই পরিত্যক্ত নকশাল বাড়ির ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে ইচ্ছুক মহিলাদের সংখ্যা বাড়তে লাগে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের পড়ুয়া মেয়েরাও এসে যোগদেয়। তাদের মধ্যে বিভা সরকার, যূথিকা চ্যাটার্জী, লায়লা পারভিন, হাফিজা আক্তার, শিরিন বানু মিতিল, জিন্নাতুন্নেছা তালুকদার ছিলেন। অবশেষে মেয়েদের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়।
বীর নারী রাজবাড়ির মেয়ে গীতা কর ভারতীয় উদ্বাস্তু শিবিরে সেবার কাজে নিয়োজিত ছিলেন । গীতার পিতা একাত্তরের ৫ মে নিহত হন। সর্বস্ব ত্যাগ করে গীতা ভারতে চলে যান। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতবাসীকে বাংলাদেশের পক্ষ নেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। গাইড হিসাবেও কাজ করেন তিনি। একাত্তরের ২ জুলাই গীতা কর গেরিলা ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ট্রেনিং শেষে আগরতলায় ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ হাসপাতালে মেডিক্যাল এটেনডেন্ট হিসেবে তিনি কাজ করেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দানে তিনি ছিলেন অন্ত প্রাণ। বাহাত্তরের জানুয়ারির ১৬ তারিখে কিছু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
দেশ মুক্তির পর একই প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে শারীরিক কারণে সেখান থেকে অবসর নিয়ে রাজবাড়িতে নিজ বাড়িতে উনার মায়ের সাথে অবস্থান করছেন। আজকের এই পোষ্ট তার চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের চালচিত্র।
প্রশিক্ষণের শেষ পর্যায় এসে প্রশিক্ষণরত মেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয়, তাদের মধ্যে কে দলের নেতৃত্ব দিবে তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় গোলযোগ। তার উপর যুদ্ধক্ষেত্রে বিমানে করে যাবার বায়না। সাথে সকল সুযোগ সুবিধা।
সারা দেশ যেখানে শত্রু কবলিত তখন যুদ্ধ করতে আসা নেতৃস্থানীয়দের এই সব সুযোগ সুবিধা চাওয়া দেখে গীতা কররা অবাক হলেন! এই সব দাবি দাওয়া আর কে হবেন দলনেতা ,তাই নিয়ে বেশ কয়েকদিন চলে গেল।
তারপর প্রস্তাব আসে কারা বিনা দাবি দাওয়ায়, বিনা সুযোগ সুবিধায় যুদ্ধে যেতে চায়! শেষ পর্যন্ত ২০০ মেয়েদের মধ্য গীতা কর সহ মাত্র ১৫ জন মেয়ে যুদ্ধে যেতে আগ্রহ জানায়। এই ১৫ জনের দলের দল নেতা করা হলো অনিলা বিশ্বাস নামের এক মেয়েকে। অনিলা ছিলেন কলেজ ছাত্রী, গোপালগঞ্জের মেয়ে। এই দলের অন্য যারা তারা হল- গীতা কর, ইরা কর, অঞ্জলি চৌধুরী,শেফালী দাস, শোভা বৈরাগী, অনিমা ওঝা, গীতা মজুমদার,রঞ্জিতা বিশ্বাস, লক্ষ্মী মন্ডল, বিশাখা মন্ডল, ছায়া হালদার, মঞ্জু বিশ্বাস, আরতি সাহা, সাবিত্রী পোদ্দার।
বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মিজানুর রহমান ও তৎকালীন মন্ত্রীপরিষদবর্গ। বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মাত্র ১০টাকা দল নেতার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মাত্র ১০ টাকা পথ সম্বল করে আর এক অবাঙ্গালীকে পথ প্রদর্শক করে বিদায় জানান হলো মুক্তিযোদ্ধাদের। কিন্তু তাদের বলে দেওয়া হলনা কোথায় যেতে হবে কি করতে হবে!
অক্টোবর মাসের দিকে হাওড়া স্টেশন থেকে রওয়ানা হয়ে আসাম যাওয়া হয়। পথে কোন খাওয়া দাওয়া হয় নাই। এক পর্যায়ে দলের গাইড অবাঙ্গালী লোকটি মেয়েদের পথ মধ্যে ছেড়ে চলে গেলেন। উপোষ কতক্ষণ থাকা যায়! হাতে মাত্র ১০টাকা! তখন ১টাকায় ৮টি কমলা পাওয়া যেত, কাজেই শুধু কমলা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করা হল।
এভাবে চলতে চলতে দলটি সিলেটের করিমগঞ্জ সীমান্তে আসে। এখানে এসে শরণার্থী ক্যাম্প দেখতে পেয়ে দলটি ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। ক্যাম্পে ঢুকে দেখা হয় এক বাংলাদেশী ছেলের সাথে যার নাম ছিল মাখন। ৮/৯ দিনের উপোষ থেকে থেকে দলের সবার ক্ষুধার যন্ত্রণায় আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জ্ঞান হারাবার উপক্রম, তাই দলের কারো শক্তি ছিলনা যে কাউকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বলার।
বাংলাদেশী ছেলেটি মেয়েদের অবস্থা বুঝতে পেরে শিউরে উঠলেন। চট জলদি শুকনো আম পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে মেয়েদের শরীর গরম করার ব্যবস্থা করলেন। তারপর সব কিছু শুনে রেশনের চালের ফেন ভাত খাওয়ালেন। সান্ত্বনা আর আশ্বাস দিয়ে ক্যাম্পের তাবুতে মেয়েদের ঘুমাতে দিলেন।
কিন্তু বিপদ দেখা দিল আবার। ভারতীয় সেনাবাহিনী মেয়েদেরকে পাকিস্তানী গুপ্তচর হিসাবে জোর করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যেতে উদ্যোগ নেয়। সাথে অশ্লীল গালাগালি। বহু বলে কয়ে প্রমাণ করা হলো যে মেয়েরা পাকিস্তানী গুপ্তচর নয় বরং মুক্তিযোদ্ধা বাঙ্গালী মহিলা। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছু হলো না। তারা হুকুম করে তাদের ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সেবা করতে হবে। এর মধ্যে এক ফাঁকে দলনেতা অনিলা সটকে পালিয়ে যায়।
অনিলা শরণার্থী ক্যাম্প ইন চার্জের কাছে খোলে বলেন যতসব বিপদের কথা। মাখন বাবুর সহযোগিতায় কোলকাতায় সাজেদা চৌধুরীর কাছে ভীষণ কঠোর ভাষায় টেলিগ্রাম পাঠান।-
--- মেয়েদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে নিজেরা গদিতে বসে আছেন। আমাদের বিমানে পাঠানোর কথা ছিল। সে টাকা আপনারা আত্মসাৎ করে আমাদেরকে ট্রেনে পাঠিয়েছেন। নিজের সন্তান হলে নিশ্চয় নিজেরা গদিতে থেকে ঠিকানা না দিয়ে এক অবাঙ্গালীর হাতে ছাড়তেন না। যদিও জানি যুদ্ধে করতে যাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আপনাদের ভিতর কোন প্রকার মনুষ্যত্ব নাই। দেশ স্বাধীন হলে দেখে নেব-!!!!!
এতসব করার পরও একদিন মেয়েদের তাবুতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ে। তখন মাখন বাবু সহ মুক্তিযোদ্ধা মেয়েরা তাদের প্রতিহত করে।
অনিলার সেই টেলিগ্রাম পাবার পর কোলকাতা থেকে মেয়েদের যাবার জন্য নির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা জানান হয়। মাখন বাবুর কাছে কয়েক দিন মেয়েরা থেকে সুস্থ হয়ে উঠে। মাখন বাবু একটি জীপ গাড়ি করে আগরতলা পৌঁছে দেন। রাতে সাইগল নামের এক ভদ্রলোকের অফিসে রাত কাটায় মেয়েরা। সকালে সেখান থেকে আগরতলা ও কুমিল্লার সীমান্তে বিশ্রাম গঞ্জ নামক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল।
এই বিশ্রামগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর জন্য ৪৮০ বেডের একটি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল বানান হয়েছে।
এখানে মেয়েদের ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানান- ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম, ডাঃ নাজিম উদ্দিন আহমদ। সাথে আরও ছিলেন- ক্যাপ্টেন আক্তারের স্ত্রী খুকু, বেগম সুফিয়া কামালে ২ মেয়ে লুলু, টুলু, পদ্মা সরকার, নীলিমা বৈদ্য, বাসনা চক্রবর্তী সহ আরও অনেকে।
মেয়েরা সরাসরি যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে আসার পরও , এখানে থেকে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ শুনে মেয়েদের মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করা কম কথা কথা নয়। ভেবে মেয়েরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় লেগে যায়।
এই ফিল্ড হাসপাতাল প্রথমে মেলাঘরে ছিল পরে আহতের সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে এখানে স্থানান্তর করা হয়। এই হাসপাতালের ব্যয়ভার ডাঃ জাফরুল্লাহর বন্ধু লন্ডন প্রবাসী কাজী কামরুজ্জামান ও অন্যান্য ডাক্তাররা বহন করতেন। সেখান থেকে তারা নিয়মিত প্রয়োজনীয় ঔষধ ও যন্ত্রপাতি পাঠাতেন। ভারত থেকে কিছু কিছু সাহায্য পাওয়া যেত।
হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ! কারও হাত উড়ে গেছে, কারও বা পা উড়ে গেছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য! কেউ সারা রাত যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। তবুও বাংলার সাধারণ মানুষের সন্তানরা ভয়ে ভীত নয় বরং প্রবল প্রতিশোধের স্পৃহায় একটু সুস্থ হলেই যুদ্ধের জন্য রণাঙ্গনে চলে যাচ্ছে। অনেকে তাদের বাবা মা ভাই বোন আত্মীয়স্বজনকে হারিয়েছেন। কেউ তাদের খবর জানেন না। ভাবনা হাত পা উড়ে যাক তারপর তো দেশ স্বাধীন হবে।
এই ভাবে একদিন বিজয়ের ধ্বনি এলো। সবাই বিশ্রামগঞ্জের হাসপাতাল ছেড়ে ১৭ই ডিসেম্বর দেশের পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। শুধু গীতা কর সহ অন্য মেয়েরা রয়ে গেলেন। কারণ দেশে তাদের কোন নিকট জন ছিলেন না।
অবশেষে ১৫/২০ জন আহত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে কুমিল্লার সোনাইমুড়ি সীমান্ত দিয়ে মেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তদেশে প্রবেশ করেন।
আমি যখন এই পোস্ট আমারব্লগের পোস্ট করি সে সময়ে আমারব্লগের সহব্লগার অনুজপ্রতিম অনুলেখা তিনি ঘটনাক্রমে রাজবাড়িতে গিয়েছিলেন। উনি আমার পোস্টে গীতাকরের ঘটনা জানতে পেরে সরাসরি গীতাকরের সাথে দেখা করে আসেন।
বাকিটি অনুর লেখা থেকে তুলে দিচ্ছি- শুভেচ্ছা, পরিচয় পর্ব এবং উদ্দেশ্য জানাতেই কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন ঠিক এভাবে "মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম দেশের জন্য, দেশ পেয়েছি। তবে আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদানের স্বীকৃতি পাইনি। এ স্বীকৃতি দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের; সে দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে দুর্ভাগ্য আমাদের"।
অনু সাক্ষাতকার শেষে আবার গীতাকরের কাছে জানতে চান- স্বাধীনতার ৪০ বছর পর তাঁর মনে কোন দুঃখ আছে কিনা? তিনি ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে বলেন "স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে নতুন করে কিছু চাওয়ার নেই। মৃত্যুর পূর্বে চাই মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদানের সরকারী স্বীকৃতি, এই রাষ্ট্রের নিকট এটাই আমার শেষ আকুতি"।
আজ স্বাধীনতার এত বছর পর গীতা কর জাতীর কাছে জানতে চান- কত মৃত্যু, কত নির্যাতন, কত যন্ত্রণা আর কষ্ট হেলাভরে পিছনে ফেলে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর সহ শিক্ষিত মানুষেরা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু মেহনতি মানুষের ঘরে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ আজও কেন পৌছাইনি? কেন? কেন? কেন?
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গীতাকরের অবদান স্বীকার করে যে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল-
কালের কণ্ঠ
ইত্তেফাক
জনকণ্ঠ
প্রথম আলো
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা টিটুর কাংখিত স্বাধীনতা!!
আমি যখন ২০০৬ জুনে সাভার ইপিজেড এ কাজে জয়েন করি তখন থেকে, কর্মস্থলে যাবার কালে পথ মধ্যে, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটের ঠিক উল্টা দিকে, সাভার ডেইরী ফার্মের ডান পাশে দেখতে পাই লাল ইটের বাঁধান একটি কবর।কবরে উপরে দুটি ফুল গাছ, একটি বকুল অন্যটি কামিনী যেন কবরটিকে ছায়া দিয়ে গভীর মমতায় আগলে রেখেছে। লাল ইটের দেওয়ালে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর টিটু। স্বভাবত কৌতুহল জাগে কে এই টিটু ? আর তার কবর বা বেদী এখানে কেন?
গাড়ির সহযাত্রীদের কয়েক বার জিজ্ঞেসও করে দেখেছি কেউই জবাব দিতে পারেন নাই। অবশেষে গত ২১শের বই মেলায় কিনা সদেরা সুজন সম্পাদনায় আমার দেখা ১৯৭১ বইয়ে ইমরুল ইউসুফের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা টিটোর গল্প পড়ে এই মুক্তিযোদ্ধার কাহিনী জানতে পারি। শহীদ টিটুর প্রতি আমার শ্রদ্ধায় বুক ভরে উঠে। হয়তো অনেকে জানেন তবুও যারা জানেন না তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে এই কাহিনী বর্ণনা করছি।
মানিকগঞ্জের শ্যামলা রঙ এর কিশোর ছেলে টিটু, চোখে ছিল দুনিয়ার মায়া ভরা দৃষ্টি, ক্লাস সেভেনে পড়তেন। ঐ বয়সের কিশোরা যা যা করত টিটুও ২৫শে মার্চের আগে তাই করতেন- ফাঁদ দিয়ে ঘুঘু ধরে, নদীতে সাঁতার কেটে, নৌকাও বেয়ে হাসি আনন্দে সময় কাটাতেন। কিন্তু ২৫শে মার্চ এই কিশোরটার সব কৈশোরের অভ্যাস দানবদের নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে নিমিষে বদলে দিল। কারণ ঐ দানবরা ওর ভাইকে রাইফেলে লাগানো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে, তার সারা গ্রাম জ্বালিয়ে পোঁড়ে ভস্মিভুত করে। ওর চোখের সামনে খান সেনারা কয়েক’শ নিরীহ মানুষকে মেরে আগুন দিয়ে পোড়ে ফেলে।
তাই সে প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করে এবং ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা পথ খুঁজতে থাকে। অবশেষে দুই নম্বর সেকটর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা হয়।ওর অভিপ্রায় জানায়। খালেদ মোশাররফ, এক যুদ্ধ পূর্ণ গভীর রাতে এই কিশোরকে, সাভারের মুক্তিযুদ্ধা টিম লিডার- নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কাছে দিয়ে যান।
অল্প সময়ের মধ্যে টিটুর সাথে নাসির উদ্দিন ইউসুফের খুব ভাব হয়ে যায়। টিটুর কেবল এক আবদার সে যুদ্ধ করবে, তাকে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে হবে। বাচ্চু ভাবেন মাত্র ১৫ বছরের কিশোরকে যুদ্ধে জড়ান ঠিক হবে না। জিজ্ঞেস করেন- তুমিতো এতো ছোট কেমন করে যুদ্ধ করবে? টিটু দৃপ্ত ভাবে চিত্কার করে বলে- আমি অগো বেবাকরে মাইরা ফালামু,ওরা আমার ভাইরে মারছে। আমি অগোরে আগুনে পুইড়া ছাই বানাবো।ওরা আমাগো গ্রাম গুলোকে পুইড়া ছাই বানাইছে। সব কয়টারে গুলি করে মাইরা প্রতিশোধ নেব।
বাচ্চু এতটুকু কিশোরের প্রতিশোধ স্পৃহা দেখে জিজ্ঞেস করেন- টিটু স্বাধীনতা বলতে কি তুমি জানো? টিটু বলে- হ’ জানি! সবাই কয় দেশ স্বাধীন হইলে সবাই নাকি সুখে থাকবো। ভাত কাপড়ের অভাব হইবোনা। দ্যাশ থিক্যা অশান্তি দুর হইবো। আমি স্বাধীনতা দেখমু। আমি যুদ্ধ করুম।
যদিও টিটুকে কিছু অস্ত্র ব্যবহার শেখানো হলো কিন্তু বয়সে খুব ছোট থাকায় তাকে সরাসরি যুদ্ধে শরিক হওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো না। অথচ তার জেদ সে যুদ্ধ করবেই। তাকে বুঝানো হলো যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা শোনা সেবা যত্ন করাটাও যুদ্ধ। তাকে সে দায়িত্বটা দেওয়া হল। কয়েক দিনের মধ্যে সে সবার প্রিয় হয়ে উঠলো।
মাস খানেকের মধ্যেই ঢাকা সাভার আরিচা সড়কের দুই পাশ দখলে আসে মুক্তিযুদ্ধাদের। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সাভার থানাও ঘেরাও করে মুক্তিযুদ্ধারা।ঐ সময় একদল পাকিস্থানী সেনাদল ঢাকার পথে ফিরছিলো। এরা এসে সাভার থানার পাকিস্থানী সেনাদের সাথে যোগ দিলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।সাথে সাথে বাচ্চু ওদের প্রতিরোধে নেমে পড়লেন। ১৪ই ডিসেম্বরের ভোরে, চার’শ মুক্তিযোদ্ধাদের বাচ্চু রণকৌশল বলে দিয়ে মাত্র ৫০ জনকে জরুরী অবস্থা মোকাবেলায় রেখে, বাকী অন্যদের চার ভাগে ভাগ করে দেন। এই ৫০ জনের দলে পড়ে টিটু, সে এটা মানতে পারেনা। সে বাচ্চুকে বলে- যুদ্ধে আমারে নিয়া যান। আমিও যুদ্ধ করুম। বাচ্চু গভীর আবেগে টিটুকে আদর করে বলেন- এই যুদ্ধে আমরা অনেকে না ফিরতে পারি। তুমি থাকো। টিটু কেঁদে বলে-আপনারা সব মইরা যাইবেন আর আমি বাইছা থাকুম ক্যান? আমিও মরুম। বাচ্চু টিটুকে জড়িয়ে ধরে বলেন- টিটো তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। তুমি না স্বাধীনতা দেখতে চাও?
যুদ্ধ শুরু হলো। তুমুল লড়াই। কিন্তু হেভী মেশিন গানটিকে ধ্বংস করতে না পারলে এ যুদ্ধে পাকিস্থানীদের হারানো যাবে না।
বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে লিডার বাচ্চু সহযুদ্ধা আরিফকে নির্দেশ করলেন- সে যেন দৌঁড়ে ২ নম্বার দলের যুদ্ধা নুরুকে বলে- যেমন করে হউক ঐ হেভী মেশিন গানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। আরিফ লিডারের নির্দেশ মতো না গিয়ে, কিশোর টিটুকে নির্দেশ দিলো। যার রক্তে প্রিয়জন হারানোর প্রতিশোধ স্পৃহা ও যার চোখে এক শোষণ মুক্ত স্বাধীনতার স্বপ্ন তাকে আর কে পায়। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে নিজেকে কাভারে না রেখে লাফ দিয়ে উঠে। কোন রৃপ রাখ ঢাক ছাড়া মুক্তি পাগল কিশোর, সোজা নুরুকে লক্ষ্য করে দৌঁড়াতে লাগল আর চিত্কার করে নুরুকে বলছিলো লিডারের নির্দেশ। ঠিক তখনই শত্রু সেনার হেভী মেশিনগানের এক ঝাঁক বুলেট এসে বিদ্ধ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা কিশোর টিটুর বুকে। বুলেটের আঘাতে, আঘাতে মাটি থেকে কয়েক হাত উপরে উঠে, ধাপাস করে মাটিতে পড়ে যায় টিটুর শরীর।মেসিনগানের বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করেছে টিটুর বুক। টিটু তখন চিত্কার বাচ্চু ভাইকে ডাকে- বাচ্চু ভাই আমাকে বাঁচান।
মুক্তিযুদ্ধারা তাদের প্রিয় কিশোর টিটুর এই অবস্থা দেখে শোককে প্রতিশোধের অগ্নিতে রূপান্তরিত করে। যুদ্ধের সব নিয়ম কানুন ভুলে এক শ্বাসরুদ্ধ কর যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্থানীদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে।
যুদ্ধ শেষে প্রতিটি যুদ্ধার একটাই প্রশ্ন - টিটু বেঁচে আছে কি? হ্যাঁ সে তখনো কাতর কণ্ঠে বলে- আমারে বাঁচান! আমি স্বাধীনতা দেখুম। স্বাধীনতা দেইখ্যা মরুম।আমারে বাঁচান!!!!!
টিটুর রক্তে ভেসে গেল ক্যাম্পের মাটি। এমাটি ধন্য হলো তার আর এক সন্তানের তাজা বুকের রক্তে শিক্ত হয়ে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে টিটু আর পাশে অসহায় সব সহযোদ্ধারা। সবার চোখে অশ্রুর বন্যা। টিটু বার বার বলতে থাকে তার খুব ব্যথা করছে। খুব শীত লাগছে। সহযোদ্ধারা একে একে ২০টি কম্বল দিয়ে টিটুকে ঢেকেও শেষ রক্ষা করতে পারছে না.... টিটুর কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে...... এখন ওর শুধু ঠোঁট কাঁপছে..... এক সময় তাও বন্ধ হয়ে গেল.. টিটু এখন সকল যন্ত্রণার উর্দ্বে চলে গেছে -- মৃত্যুর সময় হয়তো বিড় বিড় করে বলে গেছে- আমিতো স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলামনা। কিন্তু আমার দেশ স্বাধীন হবে, দেশ স্বাধীন হইলে সবাই সুখে থাকবো? ভাত কাপড়ের অভাব হইবোনা?? দ্যাশ থিক্যা অশান্তি দুর হইবো???
বি.দ্র. শহীদ টিটু বেঁচে থাকলে প্রায় আমার মতো বয়সী থেকে হতেন । কারন আমিও ঐসময় সেভেনের ছাত্র ছিলাম।সেই কারণে টিটু প্রতি আমার একটু অন্য রকমে ভাব আসে, রোজ যখন ওর কবরকে পাশ কেটে যাই। অজান্তে হাতটা কপালের কাছে উঠে আসে। এই প্রজন্মের শহীদ টিটুর উত্তরসুরীদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন মনের সব কটা জানালা খোলে ভেবে দেখুন, আজ ৩৯ বছর পরেও শহীদ টিটুর স্বাধীনতার পূর্ণতা প্রাপ্তি হলোনা কেন? কারন এই দেশের ৯৯ জন মানুষই টিটুর মতো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে, দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। ব্যক্তি বিশেষ বা গোষ্ঠী বিশেষকে কোটিপতি আমলা জেনারেল প্রধান মন্ত্রী বানাতে নয়!!!!!!!
আমি স্বাধীনতার ১৬ বছরে যখন তরুণ ছিলাম তখন একটি কবিতা লিখে ছিলাম। যা আমার প্রথম ছাপানো কবিতা। আজ তা উত্সর্গ করছি এই মহান শহীদ টিটুকে। প্রিয়তমা তুমি এলেনাতুমি এলে ভস্মস্তুপ থেকেলাল সিঁদুরের টিপ পরে;তোমার মধ্য থেকে,আমার ষোড়শী প্রিয়তমাআসার কথা ছিলো,কিন্তু সে এখনও এলো না।।হতাশার কফিন থেকেতুমি উঠে এলেথেৎলানো দূর্বা ঘাসের উপরেলাল কার্পেট বিছিয়েক্ষত বিক্ষত হৃদয়েউন্মত্ত প্রস্রবণ ধারায়স্বপ্নের আলো জ্বেলে,বিক্ষুব্ধ জলোচ্ছাসে,রক্ত মাখানো পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে,যুবতী বধু অবগুণ্ঠন থেকেএক ঝিলিক আলোর চমকানো দিয়েশুধু তুমি এলে।অথচঃতোমার মধ্য থেকেযে ষোড়শী প্রিয়তমারআসার কথা ছিলোএখনও সে এলো নাপ্রিয়তমা তুমি আজো এলে না।।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যসমূহ (Atom)